ক্ষুধা নিবারণে বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্য
অপুষ্টি, চাইল্ড স্টান্টিং বা বামনত্ব, চাইল্ড ওয়েস্টিং বা পেশীর ক্ষীণতা (উচ্চতার তুলনায় কম ওজন) এবং শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসের পথ ধরে ২০১২ সাল থেকে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দারুণ ফল করেছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক (জিএইচআই) ২০২১-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সূচকে বিশ্বের ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। ক্ষুধা নিবারণে প্রতিবেশী দেশ ভারত (১০১তম) ও পাকিস্তানের (৯২তম) এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রথমবারের মতো ক্ষুধার মাত্রায় বাংলাদেশের অবস্থান 'মধ্যম' পর্যায়ে নেমে এসেছে। ১০০-র মধ্যে বাংলাদেশের জিএইচআই স্কোর ১৯ দশমিক ১।
২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্ষুধার 'গুরুতর' পর্যায়ের ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছিল।
সারাবিশ্বে ক্ষুধা কমিয়ে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে প্রতি বছর এনজিও কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং ভেল্টহাঙ্গারহিলফ যৌথভাবে জিএইচআই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাওয়া উপাত্তের উপর ভিত্তি করে জিএইচআই স্কোর দেয়া হয়। ক্ষুধার তীব্রতার পাঁচটি পর্যায় রয়েছে – নিম্ন (৯ দশমিক ৯ বা তার কম), মধ্যম (১০ থেকে ১৯ দশমিক ৯), গুরুতর (২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯), আশঙ্কাজনক (৩৫ থেকে ৪৯ দশমিক ৯) এবং অতিমাত্রায় আশঙ্কাজনক (৫০ থেকে ১০০)।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের গবেষণা পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, "যখনই আমরা এ ধরনের কোনো সূচকের মূল্যায়ন করি, আমাদের মনে রাখা উচিত যে এসব সূচকে একটি ইস্যুর সব ধরনের প্রয়োজনীয় দিককে কভার করা হয় না।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের আরও দেখা উচিত যে বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশ যথেষ্ট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনের মতো দিকগুলোতেও উন্নতি হয়েছে। তাই এই সূচকে যে ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তা সত্য এবং আমাদের দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
"তবে এই ইতিবাচকতার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের লক্ষ্যের সঙ্গে যেন এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) সামঞ্জস্য থাকে, বিশেষত খাদ্য ও পুষ্টি সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ব্যাপারে।
"আরেকটি দিক যেখানে আমাদের অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত সেটি হলো আমাদের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার স্বাস্থ্য খাত। ওই লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করলে, এবং এসডিজির যেসব লক্ষ্যের সঙ্গে শূন্য ক্ষুধার সম্পর্ক রয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় আনলে আমাদের এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি।"
ড. সায়মার মতে, দেশের মহামারি-পরবর্তী বিভিন্ন সূচক যেমন শিশুদের অপুষ্টি ও শিশু মৃত্যু হারের ব্যাপারেও পুনর্বিবেচনা করতে হবে, কেননা মহামারি শুরুর পর থেকে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে।
"আমরা জানি, বাল্য বিয়ের সঙ্গে আগাম গর্ভধারণের সম্পর্ক রয়েছে, এবং আগাম গর্ভধারণ থেকেই আসে নিম্ন শিশু মৃত্যুর হার। ক্ষুধার উপর এই বিষয়গুলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে, তাই এগুলো পুনর্বিবেচনা খুবই জরুরি।"
তিনি আরও বলেন, সরবরাহ চক্রের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ক্ষেত্রেও উন্নতির জায়গা রয়েছে। মহামারির কারণে সরবরাহ চক্রে বিঘ্ন ঘটায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের স্ফীতি ঘটেছে। এ কারণে অনেক মানুষই পর্যাপ্ত খাদ্য কেনার সামর্থ্য হারিয়েছে।
যেভাবে চারটি সূচকে উন্নতি করল বাংলাদেশ
সূচক নির্ধারণের জন্য চারটি বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় – অপুষ্টি, চাইল্ড স্টান্টিং বা বামনত্ব, চাইল্ড ওয়েস্টিং বা পেশীর ক্ষীণতা (উচ্চতার তুলনায় কম ওজন) এবং শিশু মৃত্যু।
২০১২ সালের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার জনগোষ্ঠীর হার হ্রাস পেয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ (বর্তমানে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ)। এদিকে শিশুদের অপুষ্টির মাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, চাইল্ড স্টান্টিং বা শিশুদের বামনত্বের (পাঁচ বছরের নিচে যেসব শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম) উপর ভিত্তি করে।
২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দশ বছরে, দেশে শিশু বামনত্ব ১২ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। প্রতিবেদনের মতে, এই পরিসংখ্যান থেকে দেশের দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিজনিত সমস্যার উন্নতির চিত্রই ফুটে ওঠে।
এদিকে চাইল্ড ওয়েস্টিং বা পেশীর ক্ষীণতাও (পাঁচ বছরের নিচে যেসব শিশুর ওজন তাদের উচ্চতার তুলনায় কম) ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
তবে দেশটিতে সবচেয়ে কম পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুর হার। বর্তমানে সেটি ৩ দশমিক ১ শতাংশ, যার অর্থ, দশ বছরে এক্ষেত্রে অগ্রগতির হার মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব উন্নতির নেপথ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় উঠে আসার লক্ষ্য। অপুষ্টি সমস্যা দূরীকরণও সেই পথে অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অংশ বলে এক্ষেত্রে সরকার দৃঢ় অঙ্গীকার ও সংকল্প দেখাচ্ছে।
ক্ষুধা নিবারণে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ
এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশ রয়েছে, যাদের মধ্যে শীর্ষে শ্রীলঙ্কা (৬৫তম)। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশ ও নেপাল; উভয় দেশই ১৯.১ পয়েন্ট নিয়ে ৭৬তম অবস্থানে।
এই তিনটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষুধার তীব্রতায় 'মধ্যম' পর্যায়ে রয়েছে।
আফগানিস্তান (১০৩তম), ভারত (১০১তম) ও পাকিস্তান (৯২তম) দক্ষিণ এশিয়ায় শেষের তিনটি দেশ। এই দেশগুলো প্রত্যেকেই ক্ষুধার তীব্রতায় রয়েছে 'গুরুতর' পর্যায়ে।
ক্ষুধার 'নিম্ন' পর্যায়ে রয়েছে ৪৮টি দেশ, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেলারুশ, ব্রাজিল ও চীন। থাইল্যান্ড, ওমান ও মালয়েশিয়া সহ ৩০টি দেশ রয়েছে ক্ষুধার 'মধ্যম' পর্যায়ে।
সোমালিয়া একমাত্র দেশ হিসেবে রয়েছে ক্ষুধার 'অতি আশঙ্কাজনক' পর্যায়ে। এছাড়া পাঁচটি দেশে ক্ষুধার তীব্রতা 'আশঙ্কাজনক' এবং আরও ৩১টি দেশে ক্ষুধার তীব্রতা 'গুরুতর' পর্যায়ে রয়েছে।