বরফে ঢাকা রোগ
চান্দ্র নববর্ষ উদযাপনে চীনজুড়ে অসংখ্য মানুষ যখন নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই দেশটিতে হানা দেয় করোনা ভাইরাস। চলতি বছরের শুরুতে হুবেই প্রদেশের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল বন্যপ্রাণীর মার্কেট বলে ধারণা করেছে কোনো কোনো মহল।
তাদের এ ধারণা সত্যি বা মিথ্যা যাই হোক না কেন, করোনায় আট শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা প্রাণীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় বাড়তি সতর্ক বা শঙ্কিত করবে মানুষকে। তবে এই একটি ঘটনাতেই শঙ্কা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
মানবজাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও মারাত্মক একটি শঙ্কার কথা জানিয়েছেন গবেষকরা। তাদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় বরফের চাদর সরে গিয়ে ভেসে উঠছে মাটি। খোলা এ মাটিতেই বসত গেঁড়ে আছে অগণিত জীবাণু, যেগুলো হতে পারে মারাত্মক রোগের কারণ।
এ উদ্বেগ নিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের পাশাপাশি বসবাস করেছে মানুষ। বুবুনিক প্লেগ থেকে শুরু করে গুটিবসন্ত পর্যন্ত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করেছে মানবজাতি। বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের রোগ নতুন রূপ নিয়ে আক্রান্ত করেছে মানবজাতিকে।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন উদ্ভাবনের সময় থেকে প্রায় এক শতাব্দী ধরে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিপরীতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে ব্যাকটেরিয়াগুলো।
এ যেন এক অন্তহীন লড়াই। কারণ মানুষ রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের (প্যাথোজেন) পেছনে বিপুল সময় ব্যয় করেছে, যাতে কখনো কখনো এক ধরনের প্রাকৃতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় হাজার হাজার বছর ধরে সুপ্ত প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসগুলো হঠাৎ হানা দেওয়া শুরু করলে কিংবা অজানা অণুজীবগুলো জেগে উঠলে, মানুষ কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটা বড় প্রশ্ন।
বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনে হাজার বছর ধরে হিমায়িত মাটির উপর থেকে সরে যাচ্ছে বরফ। সেই মাটিতে সুপ্ত আদিম ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াগুলো জেগে উঠছে।
২০১৬ সালের আগস্টে উত্তর মেরুর ইয়ামাল উপদ্বীপে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়ে ১২ বছরের এক ছেলের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে কমপক্ষে ১২ জনকে।
এই অ্যানথ্রাক্সের শিকড় অনেক গভীরে। ৭৫ বছরের বেশি সময় আগে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয় একটি বল্গা হরিণ। এক খণ্ড বরফঢাকা ভূমিতে (পারমাফ্রস্ট) পড়ে ছিল তার মরদেহ।
এত বছর থাকার পর ২০১৬ সালের গ্রীষ্মে এক তাপদাহে পারমাফ্রস্ট গলে যায়। এতে উন্মোচিত হয়ে যায় বল্গা হরিণটির মরদেহ। আর এ থেকে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শুরুতে ছড়িয়ে পড়ে কাছাকাছি এলাকার পানি ও মাটিতে। পরবর্তী সময়ে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ঢুকে যায় এ জীবাণু।
ওই বছর মরদেহের পাশের এলাকায় দুই হাজারের বেশি বল্গা হরিণ আক্রান্ত হয়। কিছুসংখ্যক মানুষও এর ভুক্তভোগী হয়।
ভয়ের জায়গাটা হলো, ২০১৬ সালের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও পারমাফ্রস্ট গলবে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পারমাফ্রস্টের অগভীর স্তর প্রতি গ্রীষ্মেই গলে যায়। তবে বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও পুরনো পারমাফ্রস্টের স্তর উন্মোচিত করে দিচ্ছে।
হিমায়িত পারমাফ্রস্ট ব্যাকটেরিয়ার দীর্ঘকাল ধরে বেঁচে থাকার উপযুক্ত জায়গা। ব্যাকটেরিয়ার এ জীবনকাল ১০ লক্ষাধিক বছর পর্যন্ত হতে পারে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, গলিত বরফগুলো উন্মোচন করতে পারে রোগের প্যান্ডােরার বাক্স।