অনলাইন পাইকারি মাছের বাজারে বড় লাভের মুখ দেখছেন মৎস্য চাষিরা
মৎস্য চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন মাছের পাইকারি বাজার পিওফিশমার্কেট। সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়ানো যায় বলে মূলত জনপ্রিয়তা পেয়েছে এটি। এছাড়াও অনলাইন মার্কেটটির জনপ্রিয়তার নেপথ্যে রয়েছে ভালো দাম পাওয়ার এবং মাছ সংগ্রহ-পরবর্তী কম লোকসানের নিশ্চয়তা।
২০২০ সালের জুলাই মাসে মৎস্য অধিদপ্তরের এই অনলাইন মাছের বাজারের মাধ্যমে মাছ বিক্রি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫২ টন। চলতি ২০২১ অর্থবছরের একই সময়ে যা বেড়ে হয়েছে ১২৮ টন । অর্থাৎ এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মাছ বিক্রি বেড়েছে ৯ গুণ।
২০২০ সালের মে মাসে কোভিড পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি ফেজ ২ প্রজেক্ট (এনএটিপি-২) প্রকল্পের আওতায় অনলাইনে মাছ বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে মৎস্য অধিদপ্তর।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের মে থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত অনলাইন মাছের বাজারে ১ হাজার ৫২৯ জন ক্রেতার কাছে ২০ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা মূল্যের ৯৬৩ দশমিক ৮৭ টন মাছ বিক্রি হয়েছে।
পিওফিশমার্কেট অ্যাপ ব্যবহার করে মাছ চাষিরা সহজেই তাদের মাছ ও এর দাম সম্পর্কে তথ্য আপলোড করতে পারেন। আগ্রহী ক্রেতারা তখন মোবাইল ফোনে ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করেন।
বাজারে ক্ষুদ্র কৃষকদের প্রবেশাধিকার বাড়াতে ২২ উপজেলায় ২২টি মাছ চাষিদের সংগঠন (পিও) গঠন করা হয়েছে। এই ২২টি সংস্থার মধ্যে দুটো বিশেষ সংস্থা আছে। কারণ সংস্থা দুটোর সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০। বাকি ২০টি সংস্থার সদস্যসংখ্যা প্রায় ৭৫০।
মৎস্য চাষি ছাড়াও ব্যবসায়ীদেরও পিওর সদস্য করা হয়েছে। পিও পরিচালনার জন্য গঠন করা হয়েছে কার্যকরী কমিটি।
পিও কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত উপজেলাগুলো হলো—গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, মাদারীপুরের রাজৈর, নরসিংদীর শিবপুর, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ভোলা সদর, ময়মনসিংহের নান্দাইল ও ত্রিশাল, নেত্রকোনার বারহাট্টা, সাতক্ষীরা সদর, খুলনার ডুমুরিয়া ও পাইকগাছা, বাগেরহাট সদর, যশোরের মনিরামপুর, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, নাটোরের সিংড়া, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, পাবনার চাটমোহর, বগুড়ার আলমদীঘি, রংপুরের মিঠাপুকুর, সিলেটের বানিয়াচং, লক্ষীপুরের রায়পুর এবং কুমিল্লার নাঙ্গলকোট।
শিবপুর উপজেলা ফিশারিজ প্রোডিউসারস অর্গানাইজেশন-এর সভাপতি মো. অহিদুজ্জামান সরকার বলেন, 'পিও পরিচালনা কমিটি ও মৎস্য অধিদপ্তরের উপজেলা অফিস থেকে চাষিদের মাছ বিক্রিতে সব ধরনের সহযোগীতা করা হচ্ছে। পিওভুক্ত ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরাও চাষিদের সহায়তা করছে এ কাজে।
'এতে ছোট-বড় মৎস্য চাষিদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ওপর আস্থা বাড়ছে । ক্রমগত বেড়ে চলছে অনলাইনে মাছ বিক্রির পরিমাণ। অনলাইনে বিক্রি করা শিবপুরের মাছ যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোতে। এ কারণে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদনে অনেকের আগ্রহ বাড়ছে।'
তিনি আরও জানান, কোভিড পরিস্থিতিতেও এই অনলাইন কার্যক্রম অনেক এগিয়েছে। তবে বাজার পরিস্থিতির কারণে অনেক চাষি এখন মাছ বিক্রি করছেন না। অর্থনীতিতে চাঙা ভাব এলে অনলাইনে মাছ বিক্রি আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার হরিরামপুরের মৎস্য চাষি ফরিদ আহমেদ। সম্প্রতি তিনি মৎস্য অধিদপ্তরের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ৯ টন পাঙ্গাস মাছ বিক্রি করেছেন। কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই স্থানীয় পাইকারি বাজারের চেয়ে কেজিপ্রতি ৩/৪ টাকা বেশি দরে মাছ বিক্রি হওয়ায় অনেক বেশি লাভ করেছেন বলে জানান এই খামারি।
তিনি জানান, খুব সহজেই অনলাইনে মাছ বিক্রি করা যায়। এছাড়া পরিবহন এবং সংরক্ষণেও রয়েছে বিশেষ সুবিধা। ফলে অনলাইনে মাছ বিক্রিতে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের।
বারহাট্টা উপজেলা মৎস্য উৎপাদক সংস্থার সদস্য নুরুজ্জামান রাসেল জানান, তিনি অনলাইন প্লাটফর্মটির মাধ্যমে ২৯০ টাকা কেজি দরে ৬ হাজার কেজি পাবদা মাছ বিক্রি করেছেন। যেখানে স্থানীয় বাজারে এই মাছের দাম ছিল কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এই অনলাইন সিস্টেমের উদ্দেশ্য মৎস্য চাষি, জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অনলাইন পাইকারি বাজার চালু করা। পাইকারি মাছ বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জন্য এটি অনলাইন বিডিং প্লেসে পরিণত হবে। এভাবে মাছ চাষিরা মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার পাবেন। সেইসঙ্গে পাবেন ভালো দাম। এবং উৎপাদন-পরবর্তী লোকসানও কম হবে। খুচরা ক্রেতারাও সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন মাছ পেয়ে এই অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে উপকৃত হবেন।
এই প্রকল্পের অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (আইএফডি) এবং বিশ্বব্যাংক।
আইএফএডি বাংলাদেশ কান্ট্রি প্রোগ্রামের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আর্নোড হ্যামেলিয়ার্স বলেন, 'গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষকদের বাজারে প্রবেশের চাবিকাঠি হলো দারিদ্র্য ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই। এনএটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় মৎস্য অধিদপ্তর মাছের বিপণনের জন্য একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের চালু করেছে। এই প্ল্যাটফর্ম ক্ষুদ্র মাছ চাষিদের বড় বাজারে পৌঁছাতে সহায়তা করে।'
তিনি আরও বলেন, মাছ উচ্চ পচনশী এবং জেলেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন বলে প্রায়ই পণ্যের দাম কমে যায়। প্রচলিত মাছ বাজারের বাইরে গিয়ে অনলাইনে মাছ বিক্রিতে ব্যাপক সাফল্য এসেছে বলে জানান তিনি।
এনএটিপি-২ প্রকল্পের প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটের পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, দেশে মাছের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। উৎপাদনের সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থা সহজ করতে চলমান এনএটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় অনলাইনে মাছ বিপণনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে এই উদ্যোগ সফলতা পেয়েছে। এই পাইটল কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে সারা দেশে অনলাইন কার্যক্রম সম্প্রসারণে মৎস্য অধিদপ্তর আরও নতুন উদ্যোগ নেবে।
এদিকে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ২৪ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।
ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ১৪টি মিনি ফিশ প্রসেসিং প্ল্যান্ট (মূল্য সংযোজিত পণ্যের বিকাশের জন্য) নির্মাণ করা হবে। এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় অনলাইন বাজার সম্প্রসারণের জন্য একটি অনলাইন মাছ বিপণন ওয়েবসাইট/অ্যাপ চালু করা হবে।
এ প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় মাছের বাজার, পাইকারি মাছের বাজার ও চেইন শপে মাছ সরবরাহ করা হবে। দেশের ১৮টি জেলার ২৯ উপজেলায় এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে।
২০১৯-২০ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৫৪.০৩ লাখ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ৫ কোটি টাকা।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৯.০১ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন নতুন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪০৮ দশমিক ৯৮ কোটি টাকার মোট ৭৬ হাজার ৫৯১.৬৯ টন মাছ রপ্তানি হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১ লাখ মেট্রিক টন মাছ রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।