বিশ্বকাপে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে কখনোই ঠিক জমাতে পারেনি টাইগাররা। বিশ্বকাপগুলোই এর সাক্ষী। ২০০৯, ২০১০ ও ২০১২; এই তিন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একটি ম্যাচেও জিততে পারেনি বাংলাদেশ।
২০১৪ বিশ্বকাপ থেকে শুরু হয় 'বাছাই পর্ব' গোছের গ্রুপ পর্বের খেলা। ঘরের মাঠে সেবার গ্রুপ পর্ব পেরুলেও সুপার টেনে সবকয়টি ম্যাচেই হারে বাংলাদেশ। দুবছর পরও একই পরিণতি দেখতে হয় টাইগারদের। তবে সেবার আরও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদায় নেয় তারা । ২০১৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে শেষ ওভারের ট্র্যাজেডি এখনো টাইগার ভক্তদের মনে সতেজ থাকার কথা।
পাঁচ বছর বাদে আরেক বিশ্বকাপ। এবার কি বদলাবে টাইগারদের ভাগ্য? এই প্রশ্নের উত্তরে বর্তমানে 'হ্যাঁ' বলার লোক তেমন পাওয়া যাবে না। স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে এবারের বিশ্বকাপ-যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। যে পরাজয়ের পর বিসিবি প্রধান প্রকাশ্যে দল ও দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের নিয়ে চরম সমালোচনা করেন।
ওমান ও পিএনজিকে হারিয়ে দলের সমালোচনায় 'আহত' হওয়া মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বলেন, "আমরাও মানুষ। আমাদেরও অনুভূতি কাজ করে। আমাদের পরিবার আছে। তারাও মন খারাপ করে।"
"সমালোচনা অবশ্যই হবে, খারাপ খেলেছি। তবে একেবারেই ছোট করে ফেলা ঠিক নয়। আমাদের সবার কাছেই খারাপ লেগেছে… আমার মনে হয় কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়," যোগ করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
তবে পরের ম্যাচেই আবার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি করে দেয় মাহমুদউল্লাহ-বাহিনী। সুপার টুয়েলভে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্রুপে পরা বাংলাদেশের জন্য খাতায় কলমে সবচেয়ে সহজ প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা।
গ্রুপ পর্ব খেলা শ্রীলঙ্কার সাথে শুরুটা ভালোই করেছিল বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করে শক্তিশালী একটি সংগ্রহ বোর্ডে তুললেও দ্বিতীয় ইনিংসে আবার সেই 'পুরনো বাংলাদেশ'। বোলিংয়ে বাজে পরিকল্পনা ও ক্যাচ মিসের মহড়ায় আরেকটি স্বভাবসুলভ পরাজয়কে বরণ করে দেয় মাহমুদউল্লাহরা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবারও যেন কড়া নাড়ছে।
আগামীকাল ২৭ অক্টোবর আবুধাবিতে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে টাইগাররা। এই ম্যাচে হারলে সুপার টুয়েলভ শুরু হওয়ার পাঁচ দিনের মাঝেই বাংলাদেশের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাবে একরকম।
তবে ৫০ ওভারের চ্যাম্পিয়নদের সামনে টাইগারদের কোনো আশা নেই যে তা নয়। পিএনজির বিপক্ষে জেতার পর মাহমুদউল্লাহ বলেছিলেন, এই ফরম্যাটে পারফরম্যান্সের ওঠা-নামা সব সময়ই থাকবে। অধিনায়কের কথা ঠিক উড়িয়ে দিতে পারবেন না আপনি। এই ফরম্যাটের ধরণটাই এমন, টানা শীর্ষ পর্যায়ে পারফর্ম করে যেতে পারে না কোনো দল। হুট করে কোনো এক ম্যাচে সম্মিলিতভাবে খারাপ করে বসতে পারে পুরো দল। শনিবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৫ রানে অলআউট হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেন তারই প্রমাণ দিল।
এছাড়া রাউন্ড-রবিন ফরম্যাটের টুর্নামেন্টে খুব ঘন ঘন ম্যাচ খেলতে হয় প্রতিটি দলের। এসময় কোনো এক ম্যাচে দলের ছন্দ হারিয়ে ফেলাটা খুবই স্বাভাবিক। আগামীকাল ও বিশ্বকাপে সামনের কয়েক ম্যাচে হয়তো এমন 'ছন্দ হারানো' কোনো দলেরই খোঁজ করবে বাংলাদেশ।
জেতার অনুপ্রেরণার জন্য বেশিদূর তাকাতে হবে না টাইগারদের। শেষ দুই টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকেই সাহস নিতে পারে তারা। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে এসেছে বাংলাদেশ। যদিও ঘরের মাঠে সুবিধাজনক কন্ডিশনে খেলে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলে এসেছে এসব জয়, কিন্তু কী আসে যায়? বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এসেছে টি-টোয়েন্টিতে ছয় নাম্বার র্যাঙ্কিংয়ে দাঁড়িয়ে। ছয়ে যাওয়ার পথে অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং দুবারের বিশ্বকাপজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পিছনে ফেলেছে তারা।
ইতিহাস বলে, ক্রিকেটে 'আহত ও কোণঠাসা বাঘ'-এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু নেই। রূপক ও আক্ষরিক অর্থ, দুভাবে বাংলাদেশ এখন 'কোণঠাসা বাঘ'। তবে কি সর্বোচ্চ আসরে আবারও গর্জন করতে পারবে টাইগাররা?
আগামীকাল ইয়ন মরগান ও তার দল যে বাংলাদেশকে হালকাভাবে নিবে না, সেটা নিশ্চিত। ২০১৫ সালে অ্যাডেলেডের সেই ঐতিহাসিক জয়ের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দুনিয়াকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ।
এ ম্যাচে হেরেই সীমিত ওভারের দল, দর্শন সবকিছু পরিবর্তন করে ইংল্যান্ড। সেই সাথে পরিবর্তন করে দেয় সাদা বলের ক্রিকেটকেও।
ডিসেম্বরে অ্যাশেজে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা থাকলেও আগামীকালকে আবুধাবির মাঠে নিশ্চিতভাবেই দেখা যাবে না বেন স্টোকসকে। যার মানে, মাঠের শীর্ষ তারকাটি পরবে লাল-সবুজ জার্সিই। সাকিব আল হাসানের টি-টোয়েন্টি পরিসংখ্যান যেকোনো পরিসংখ্যানবিদকেও অবাক করে দিবে। লাসিথ মালিঙ্গাকে পিছনে ফেলে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তকমাটা সম্প্রতিই নিজের করে নিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।
বলের মতো ব্যাট হাতেও সমান কার্যকরী সাকিব। এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনিই। অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংকের শীর্ষস্থানকে একরকম নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা সাকিব এই বিশ্বকাপেও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করছেন। বর্তমানে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি, এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি।
১৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাওয়া সাকিব বিতর্কে জড়ানোর বেলাতেও ঠিক ততটাই ধারাবাহিক।
২০০৯ সালে একজন জুয়াড়ির ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করার জন্য এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ সাকিবকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে আইসিসি।
নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া সাকিব মহামারী না আসলে হয়তো খেলতেই পারতেন এই বিশ্বকাপে। নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী সময়েও যে সাকিব নিজেকে বিতর্কের বাইরে রেখেছেন, তা না। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে রেফারির সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে এবং উইকেট ভেঙে আবারও শিরোনাম হয়েছিলেন এই শীর্ষ অলরাউন্ডার।
সাকিবের এই আগ্রাসী মনোভাব মাঠে বাংলাদেশকে একরকম উপকৃতই করে। দল হিসেবে বাংলাদেশের মানসিকতায় আগ্রাসনের কমতি নেই। লিটন দাসের ব্যাট ঘুরানো বা নাসুম আহমেদের উদযাপনই বলে দেয় 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী' মনোভাব নিয়ে আরব আমিরাতে পা রেখেছে টাইগাররা।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও হয়তো নিজেদের প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার পরিচয় দিবে সাকিব-মাহমুদউল্লাহরা। টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে চাইলে এই ম্যাচে জেতার কোনো বিকল্প নেই, জেতার বিকল্প নেই দুর্দশার চক্রকে ভাঙতে চাইলেও।
'সম্মানজনক' পরাজয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে অবশেষে টাইগাররা বিশ্বকাপের মূল পর্বের কোনো ম্যাচে শেষ হাসি হাসতে পারে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।