বন্যহাতির জন্য মরণফাঁদ হবে ২৭ কিলোমিটার রেলপথ
একের পর এক বনাঞ্চল ধ্বংস করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং রোহিঙ্গাদের কারণে বিশাল বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে বাড়ছে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব। আবার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কারণেও বাধাগ্রস্ত হবে ৬টি করিডোর। চলাচলের করিডোর বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং খাবার সংকটের কারণে নিয়মিতভাবে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বিপন্ন এশিয়ান হাতি। ফলে বাড়ছে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্বও। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ফরেস্ট (আইইউসিএন) প্রকাশিত বিপন্ন প্রাণীর লাল তালিকায় আছে এশিয়ান এলিফ্যান্ট।
হাতি নিয়ে কাজ করা আইইউসিএনের কো-অর্ডিনেটর আবদুল মোতালেব বলেন, এশিয়ান হাতিগুলো মিয়ানমার এবং ভারতে আসা যাওয়া করে। মিয়নমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে বনভূমি উজাড় হওয়া, সীমান্তে মাইন পোঁতা, এবং বনের জায়গায় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হাতি চলাচলের করিডোর। তাছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণের ফলে সংরক্ষিত বন যেমন ভাগ হবে, তেমনি হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীও হুমকিতে পড়বে।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রায় ২৭ কিলোমিটার বন্যহাতির জন্য মরণফাঁদে পরিণত হবে। ওই রেললাইনের অন্তত ২১টি স্থানে পড়বে হাতির বসতি এবং চলাচলের পথ। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ১২৮ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭ কিলোমিটারের মতো পড়ছে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফাইস্যাখালী (ফাঁসিয়াখালী) বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ভেতর।
তবে রেল বিভাগ থেকে হাতি ও বন্য প্রাণী চলাচলের জন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ করা হলেও হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমার সম্ভাবনা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
দেশের অন্যতম তিনটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ২৭ কিলোমিটার বনাঞ্চলসহ ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন। ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ডুয়েল গেজ এ রেললাইন নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২২ সালে। এর মধ্যে চুনতি দিয়ে যাবে ১৫.৮ কিলোমিটার, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য অঞ্চল দিয়ে ১০.৩ কিলোমিটার এবং দশমিক ৯ কিলোমিটার পথ যাবে মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের আওতায় দাতা সংস্থা এডিবির যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইল্ড লাইফ কনসালট্যান্ট নরিস এল. ডোড এবং একই সংস্থার বাংলাদেশের ন্যাশনাল এনভাইরোনমেন্টাল কনসালট্যান্ট আসিফ ইমরান যৌথভাবে গবেষণা পরিচালনা করেন। তিনটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দুইটি সার্ভে পরিচালনা করা হয়। প্রথমটি ২০১৭ সালের ৮-১৫ এপ্রিল, দ্বিতীয়টি ৩১ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর।
ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে চুনতিতে ১১টি, ফাঁসিয়াখালীতে ৭টি এবং মেধাকচ্ছপিয়াতে ২টি ক্যামেরা বসানো হয়। প্রায় সাত মাস ধরে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এসব ক্যামেরা। গবেষণায় তিনটি বনাঞ্চলের ২১টি স্থানে হাতির চলাচলের পথ এবং আবাসস্থল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৩টি স্থান চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, সাতটি ফাইস্যাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও একটি মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কে। চুনতিতে ১৩টির মধ্যে নয়টিতে উভয় মৌসুমে হাতির আনাগোনা দেখা যায়। ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের জন্য চুনতিতে ১১টি, ফাইস্যাখালীতে সাতটি ও মেধাকচ্ছপিয়াতে দুটি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪৭টি হাতি আছে এখানে। মোট হাতির ৫৭ শতাংশের দেখা মেলে এ বনে।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বলেন, বন্য প্রাণী ও হাতির চলাচলের কথা মাথায় রেখে আমরা ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করছি। জীববৈচিত্র্যের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য আমরা প্রকল্প শেষ হলে ৭ লাখ গাছের বনায়ন করব।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২০০৩ সালে থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ২৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবার একই সময়ে হাতি মারা গেছে ৬২টি। সর্বশেষ গত এক বছরের হাতি মারা গেছে তিনটি। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট হাতির সংখ্যা ২১০-৩৩০টি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতি রয়েছে ২৬৮টি।
সবচেয়ে বেশি হাতি দেখা যায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে। এখানে হাতি রয়েছে ৬৫টি। কক্সবাজার দক্ষিণে ৫৪টি, উত্তরে ৬৩টি, লামায় ৩০টি, বান্দরবানে ১১টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরে ২৮টি এবং দক্ষিণে ১৭ হাতি রয়েছে।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে বৃহত্তর চট্টগ্রামে হাতির আক্রমণে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু গত নভেম্বর মাসে লোকালয়ে হাতির আক্রমণে বোয়ালখালীতে ৫ জন এবং লোহাগাড়ায় একজনের মৃত্যু হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও হাতি বিশেষজ্ঞ ড. এইচ এম রায়হান সরকার বলেন, বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে রেললাইন নির্মাণ করা হলে হাতি ছাড়াও অন্যান্য বন্য প্রাণীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রজননেও সমস্যা তৈরি হবে।
পৃথিবীর কোনো দেশে সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন নিয়ে যাওয়ার নজির নেই। বর্তমান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের পাশ দিয়ে এ রেললাইন নিয়ে যাওয়া হলে কোনো সমস্যা হতো না। ভারতে বনের ভেতর দিয়ে সামান্য পরিমাণ রেললাইন হলেও তাতে দুর্ঘটনায় হাতি মারা যাওয়ার নজির আছে।