‘দেশে ফেরার আগে দুই দিন অনেক লম্বা মনে হচ্ছে’
যুব বিশ্বকাপের পর্দা নেমেছে ৯ ফেব্রুয়ারি। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নিয়েছেন বাংলাদেশের যুবারা। আসর শেষ হলেও দেশে ফিরতে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে তাদের। ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দেশে পৌঁছাবেন তারা।
দেশে ফেরার আগে মাঝের এই দুই দিন ( ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি) অনেক লম্বা মনে হচ্ছে অধিনায়ক আকবর আলীর কাছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় দলের মূলমন্ত্র, অনুপ্রেরণা, বিশ্বাস, কোচিং স্টাফ, দেশে ফেরার রোমাঞ্চসহ অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বিশ্বকাপজয়ী এই অধিনায়ক।
টিবিএস: বাংলাদেশ এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন—এই বাক্যটা শুনতে কেমন লাগছে? কতটা তৃপ্তি দিচ্ছে?
আকবর আলী: এটা আসলে স্পেশাল ফিলিংস; বলে বোঝানো যাবে না। একটু পরপরই শিরোপা জেতার কথা মনে পড়ছে। আসলেই অনেক স্পেশাল এটা। বিশ্বকাপ জেতার অনুভূতি বোঝানো সত্যিই কঠিন।
টিবিএস: শিরোপা জেতার পরের দিনটা কীভাবে কাটিয়েছেন? কী কী করেছেন এদিন?
আকবর: ওই রকম বিশেষ কিছু করা হয়নি আসলে। আমরা পচেফস্ট্রুমে ছিলাম। সেখান থেকে জোহানেসবার্গে চলে এসেছি। লাঞ্চ শেষে নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব করেই সময় কেটেছে।
টিবিএস: শিরোপা জেতার রাতে ঠিকমতো ঘুমুতে পেরেছেন?
আকবর: হা হা হা, খুবই কম ঘুমিয়েছি। ডিনারের আগে আমরা ড্রেসিং রুমে শিরোপা জয় উদযাপন করেছি। ডিনারের পরেও আমরা একটু উদযাপন করেছি। তাই ওই রাতে ঘুমাতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল।
টিবিএস: এখন ওখানে থাকতে ভালো লাগছে? দেশে ফেরার আগে মাঝের এই দুই দিন একটু বেশি লম্বা মনে হচ্ছে না?
আকবর: হ্যাঁ, আসলে লম্বাই মনে হচ্ছে। কারণ এই দুই দিন কোনো অনুশীলন নেই, খেলাও নেই। রুমে বসে বসে গল্প-গুজব করে দিন যাচ্ছে। দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছি যেহেতু, মাঝের এই দিন দুটি লম্বাই মনে হচ্ছে।
টিবিএস: শুধু ক্রিকেটার হিসেবে নয়, অধিনায়ক আকবর আলীর যে প্রশংসা হচ্ছে, এটা কতটা উপভোগ করছেন?
আকবর: এটা অবশ্যই ভালো লাগার মতো ব্যাপার। তবে প্রশংসা যারা করছেন, এটা তাদের ওপর নির্ভর করে। তবে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে আমাদের তুলনা করাটা কখনোই ভালো কিছু নয়। এটা অনেক বড় অর্জন, ঠিক আছে। কিন্তু আরও অনেক বিষয়ই মাথায় রাখা দরকার।
টিবিএস: বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা আপনার অধিনায়কত্বের প্রশংসা করেছেন। এটা আপনার জন্য কতটা ভালো লাগার ব্যাপার?
আকবর: আমি আসলে ওইভাবে নিউজ পড়ি না। তারপরও দুই-একজন দেখাল, মাশরাফি ভাইয়েরা প্রশংসা করেছেন। এটা তো অনেক ভালো মন্তব্য। ভালো লাগার মতো ব্যাপার। মাশরাফি ভাই অনেক বড় মানুষ। উনি যদি কোনো কমেন্ট করেন, সেটার একটা ওজন থাকে। উনি যদি আমার ব্যাপারে ভালো কিছু বলে থাকেন, তাহলে অবশ্যই এটা স্পেশাল কিছু।
টিবিএস: ফাইনাল ম্যাচের চাপ, আবার কঠিন অবস্থাও তৈরি হয়েছিল, যেখানে আপনি ব্যাট হাতে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে শিরোপা জিতিয়েছেন। সব মিলিয়ে এটাকে আপনার ক্যারিয়ার সেরা ম্যাচ বলা যায়?
আকবর: যদি ম্যাচের তাৎপর্য বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলব এই ম্যাচ এখন পর্যন্ত আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
টিবিএস: ইনিংসটি খুব বড় নয়; ৪৩ রানের। কিন্তু এই মাঝারি ইনিংসেই ইতিহাসের পাতায় নাম উঠেছে বাংলাদেশের। ইনিংসটা কতটা স্পেশাল?
আকবর: অবশ্যই স্পেশাল। কিন্তু যদি ম্যাচ না হিসাব করে শুধু ইনিংসের কথা বলা হয়, এমন আরও বেশ কিছু স্পেশাল ইনিংস আছে আমার। তবে এটা যেহেতু বিশ্বকাপ ফাইনালের, তাই এটা অবশ্যই স্পেশাল।
টিবিএস: পুরো টুর্নামেন্টে আপনাদের অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখিয়েছে। লম্বা এই সফর ভালোভাবে শেষ করার জন্য পুরো দলের মূলমন্ত্র কী ছিল?
আকবর: এখানে আমাদের সবার ভাবনা এক ছিল। ম্যাচের ফল নিয়ে আমরা কখনোই চিন্তা করিনি। গত এক বছর আমরা অনেক ক্রিকেট খেলেছি, নিজেদেরকে প্রমাণ করেছি। সেসব অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে।
এর চেয়ে বড় বিষয়, কারও মধ্যে কোনো নেতিবাচক মনোভাব ছিল না। আমরা সবাই খুব ইতিবাচক ছিলাম যে, এসেছি, ভালো ক্রিকেট খেলব। সবার মধ্যেই একটা ব্যাপার ছিল যে, আমরা জিতব।
টিবিএস: বিশ্বকাপের আগে থেকেই আপনাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। যাওয়ার আগে বলেছিলেন, শুধু জিম্বাবুয়ে, স্কটল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো নয়, পুরো বিশ্বকাপ জেতার সামর্থ্য আপনাদের আছে। এভাবে বলতে কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে সাহস জুগিয়েছে, কোন ব্যাপারটি সবচেয়ে অনুপ্রেরণার ছিল?
আকবর: ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডে আমরা যে সিরিজ দুটি খেলেছি, সেখানে আমাদের খুব ভালো সময় গেছে। আমরা সবাই বেশ ভালো ছন্দে ছিলাম। সেখানকার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের সবারই মনে হয়েছে আমরা যদি আমাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারি, তাহলে আমরা যেকোনো দলকে হারাতে পারব। সেই বিশ্বাসটা আমাদের ছিল।
দেশ ছাড়ার আগেও আমি বলে এসেছিলাম যে, আমরা ফাইনালের লক্ষ্য নিয়েই যাচ্ছি। তো সবকিছু সেভাবেই হয়েছে।
টিবিএস: লম্বা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন আপনারা। এ পথে বিসিবির অনেকেই আপনাদের পাশে ছিলেন। খালেদ মাহমুদ সুজনের কথা যদি আলাদা করে বলতে বলা হয়, তাহলে কী বলবেন?
আকবর: আমরা অবশ্যই অনেক কৃতজ্ঞ এবং তাদেরকে অনেক বেশি ধন্যবাদ যে আমাদের এতগুলো ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন। গেম ডেভেলপমেন্টের তত্ত্বাবধানে যেহেতু আমাদের ম্যাচ থাকে, আর গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান উনি, তো বড় কৃতিত্ব উনাকেই দিতে হবে।
টিবিএস: ট্রেনিং ও স্ট্রেন্থ কোচ রিচার্ড স্টয়নারকে মাঠে অনেক বেশি সরব থাকতে দেখা গেছে। পুরোটা সময় আপনাদের চিয়ারআপ করে গেছেন তিনি। দেখে মনে হয়েছে, তার সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কটা বেশ গভীর। এ ব্যাপারে যদি একটু বলতেন…
আকবর: আমার মনে হয়, তার এনার্জির শেষ নেই। তার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি হচ্ছে চুপ করে বসে থাকা। তাকে যদি বলা হয় চুপ করে ১০ মিনিট বসে থাকতে, সে পারবে না এটা আমি নিশ্চিত। তার ভেতরে অনেক এনার্জি।
এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো এবং ইতিবাচক একটা ব্যাপার ছিল। আমরা থেমে যেতাম, কিন্তু সে কখনো থামত না।
টিবিএস: ফাইনালে আপনাদের মধ্যে অনেক বেশি আগ্রাসন দেখা গিয়েছে। প্রতিপক্ষ ভারত বলেই কি আপনাদের শরীরী ভাষা এমন ছিল?
আকবর: দেখুন, ভারত সবসময়ই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে। ওদের সাথে খেলতে হলে আপনাকেও আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে হবে। তা না হলে আপনি ওদের সাথে পেরে উঠবেন না।
আমরা যখন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছি, আমরা জানতাম ওরা অনেক বেশি ভদ্র। ওরা ক্রিকেট জাতি হিসেবে অনেক ভদ্র। তাদের সাথে আমাদের পরিকল্পনা একেবারে ভিন্ন ছিল। আবার ভারতের বিপক্ষে পুরোপুরি ভিন্ন। তো এটা নির্ভর করে আপনি কাদের বিপক্ষে খেলছেন।
টিবিএস: অতীতে বাংলাদেশ কখনোই ফাইনাল জিততে পারেনি। একটা বাধা পেরোনো গেল। এখন তো এটা বলাই যায়…
আকবর: ফাইনালটাকে আমরা নরমাল ম্যাচ হিসেবেই চিন্তা করতাম। ফাইনাল হলে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা একটা নরমাল ম্যাচ হিসেবেই দেখতাম। ভাবতাম একটা নরমাল ম্যাচ হেরেছি। তো একটা শুরু হওয়ার দরকার ছিল, সেটা শুরু হলো আর কি।
টিবিএস: টুর্নামেন্ট চলাকালীন আপনার বোন মারা যায়। এই শোক কাটিয়ে খেলে যাওয়া কতটা কঠিন ছিল?
আকবর: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার জন্য খুব কঠিন। দুঃখিত, এই বিষয়ে কিছু বলতে পারব না আমি।
টিবিএস: ফাইনালের পর মাঠে ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় বাংলাদেশের তিনজন ও ভারতের দু'জন ক্রিকেটারের শাস্তি হয়েছে। ৮-১০টা করে সাসপেনশন পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে এসব ক্রিকেটারকে। এটা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? শাস্তিটা কি একটু বেশি হয়ে গেছে বলে মনে হয়?
আকবর: শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটার নয়, ভারতের দু'জনও কিন্তু শাস্তি পেয়েছে। আমরাও ভুল করেছি, তারাও ভুল করেছে। দুই পক্ষেরই ভুল। এই পর্ব শেষ। যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেটা সবাই মেনে নিয়েছে। ভারতের খেলোয়াড়, আমরা সবাই একই হোটেলে ছিলাম। সবাই আমরা মাঠেই হ্যান্ডশেক করেছি।
হোটেলে এসে বুঝতে পেরেছি যে, ওটা আবেগ থেকে চলে এসেছিল। তো এটা হয় আর কি।
টিবিএস: পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। ওই হারের পর সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মুমিনুল হক বলেছেন, আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে তাদের। মুমিনুলের এমন মন্তব্যকে কীভাবে দেখছেন?
আকবর: এটা সৌরভ (মুমিনুল) ভাই-ই ভালো বলতে পারবেন, কেন বলেছেন। তবে আমি মনে করি আমাদের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারুক আর না পারুক, উনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের।