সূর্যটা যদি নিভে যায়
ফুঁ দিয়ে সূর্য নিভিয়ে দেবার মতো দুঃসাহসও নাকি কেউ কেউ দেখিয়েছেন। গ্রিক দেবতা ইশরুস ডানা ঝাঁপটে সূর্যে পৌঁছাতে চেয়েছিল কিন্তু সূর্য তাকে স্বাগত জানায়নি, ডানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
বিখ্যাত 'ব্লো আউট দ্য সান অ্যালবামের গানটি অনেকেরই শোনা :
Hey wouldn't it be fun
If we could blow out the sun
And the loving that we found tonight
Wont disappear in the marring light
সূর্যটাকে নিভিয়ে দিতে পারলে রাতটাকে আরও প্রলম্বিত করা যেত, দীর্ঘতর হতো প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গন।
কিন্তু সুকান্ত চট্টোপাধ্যায় এমনভাবে শীতের সূর্যটা হিমশীতল সুদীর্ঘ রাতের প্রতীক্ষার পর চাইলেন যে মনে হলো এ সূর্য নেভানো ঠিক হবে না।
হে সূর্য:
তুমি আমাদের স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
হে সূর্য!
মহাকাশের লালচে নক্ষত্রগুলোর মধ্যে বামন লাল নক্ষত্র হচ্ছে সূর্য, অন্য সব নক্ষত্রের তুলনায় তেমন বড় নয়। তবে সূর্যের নিজস্ব যে সৌরজগৎ সেখানে সূর্য মহারাজাধিরাজ। সৌরজগতের মোট যে ভর, তার ৯৯.৮৬ ভাগ সূর্য একাই বহন করে থাকে। সূর্য নামের গোলকটির ব্যাস ১.৪ মিলিয়ন কিলোমিটার, তার মানে সূর্যের গোলকের ভেতর পৃথিবীর মতো অন্তত দশ লক্ষ গোলক ঠাঁই দেওয়া যাবে।
সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করছে। মহাজাগতিক কেন্দ্র থেকে ২৪ থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে সূর্যের অবস্থান। সূর্য আরও ১৩০ মিলিয়ন বছর পর হাইড্রোজেনশূন্য হয়ে পড়বে। তখন সূর্যের আকার ক্রমেই বাড়তে থাকবে এবং নিকটবর্তী তিনটি গ্রহ মার্কারি, ভেনাস ও পৃথিবীকে খেয়ে ফেলবে এবং লাল নক্ষত্রে পরিণত হবে। সূর্যের বয়স এখন সাড়ে চার বিলিয়ন বছর, বলা যায় সূর্য মাঝবয়সী। সূর্যের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিউক্লিয়ার ফিউশনের কারণে উত্তাপ সৃষ্টি হয়।
এই সূর্যকে কি নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হবে?
গানে-ছড়ায়, কবিতায়-গল্পে, কল্পনায় অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তা কেমন করে হবে? ফায়ার ব্রিগেড পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে থাকে। কিন্তু সূর্যের আগুন নেভাতে কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন হবে? পানি কেমন করে সূর্যে পৌঁছানো হবে। পৃথিবীর সব পানি ঢেলে দিলেও কি সূর্য নিভবে? মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় আইসকিউব যদি পাঠানো হয় সূর্যগহ্বরে? পৃথিবী থেকে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে পৃথিবীর ২.৭ গুণ ব্যাসের একটি শনি গ্রহ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন এঔ১২১৪৬; আমরা বলি ওয়াটার ওয়ার্ল্ড। এটাকে যদি মহাজাগতিক কোনো প্রক্রিয়ায় টেনে এনে সূর্যের ওপর নিক্ষেপ করা যায়। কিন্তু আনার পথেই তো সব পানি বরফে পরিণত হয়ে যাবে। তারপর কি সূর্যের ওপর বরফঝড় শুরু করা যাবে, নাকি সূর্যগহ্বরে প্রবেশ করার আগেই বরফ পানি হতে হতে বাষ্প হয়ে আবার মহাকাশেই ছড়িয়ে পড়বে। সূর্যের আয়ু বড়জোর আর ৫ বিলিয়ন বছর। তারপর এমনিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু মানুষ হিসেবে সূর্যের মৃত্যু দেখার সুযোগ কি আমরা পাব?
একেবারে সহজ উত্তরটি হচ্ছে না। মানবজাতির আয়ুষ্কাল আর বড়জোর ১ বিলিয়ন বছর। কাজেই সূর্য নিয়ে তাদের আর দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
তারপরও এখন যদি সূর্যের সুইচ হঠাৎ অফ হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর কি হবে?
সৌর হস্তক্ষেপ
১৮৫৯ সালে একটি বিশাল সৌরঢেউ ও চুম্বকীয় ঝড় পৃথিবীকে আঘাত করে। চুম্বকীয় ঝড় তারে বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে। ১৮৫৯ সালে পৃথিবী টেলিগ্রাফের তারে বেস্টিত ছিল। সেই ঝড়ের কারণে তারে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়, টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন স্থানে তারে ও টেলিগ্রাফ যন্ত্রপাতিতে আগুন ধরে যায়।
১৮৫৯ সালের পৃথিবীতে বহু বিচিত্র তারের সমারোহ বেড়েছে। সেই ঝড়টি যদি এখন হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির হিসাবে তা বহু ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াত- এ পর্যন্ত সকল হারিকেনের মোট যে ক্ষতি, তার চেয়েও বেশি। কিন্তু সূর্য যদি নিভে যায়, এ ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা একেবারেই থাকবে না।
স্যাটেলাইট সার্ভিস
সূর্যের সামনে দিয়ে যখন কোনো কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট যায়, সূর্য ভূ-উপগ্রহের রেডিও সিগন্যাল এলোমেলো ও নষ্ট করে দিয়ে কাজে ভয়ংকর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সূর্য যদি অকেজো হয়ে যায়, তাহলে এই সমস্যা থেকে সহজে মুক্ত হওয়া যাবে।
উন্নততর মহাকাশবিদ্যা
সূর্য না থাকলে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের ভূমিভিত্তিক সকল পর্যবেক্ষণ যন্ত্র চব্বিশ ঘণ্টাই চালানো যাবে। শীতল বাতাস বায়ুম-লে কম হইচইয়ের সৃষ্টি করবে, তাতে অ্যাডাপটিভ অপটিকস সিস্টেমের ওপর চাপ কমিয়ে দেবে এবং উন্নততর ছবি ধারণ করার সুযোগ দেবে।
অবকাঠামো ব্যয় হ্রাস
ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপর্টেশন হিসাব দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে সেতু মেরামতও রক্ষণাবেক্ষণে আগামী ২০ বছর বছরপ্রতি ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। অধিকাংশ সেতুই পানির ওপর। যদি সূর্য না থাকে তাহলে পানিটা হবে জমাট বাঁধা বরফ। বরফের ওপর এক চিলতে অ্যাসফন্ট বসিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। এর ওপর দিয়ে যানবাহন আসা-যাওয়া করবে, সময়ও কম লাগবে।
বাণিজ্য সুবিধা
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন টাইম জোন হওয়াতে বাণিজ্যের খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়, যখন একদিকে দিন, অন্যদিকে রাত, যখন একদিকে অফিস খোলা, অন্যদিকে বন্ধ। যদি সূর্য একেবারে বিদায় নেয়, তাহলে বিভিন্ন টাইম জোনের প্রয়োজন নেই, সকলেই তখন UTC অনুসরণ করবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তা বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি করবে।
নিরাপদ শিশু
নর্থ ড্যাকোটা স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশ হচ্ছে, ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের রোদে আনা যাবে না। তা বেশ, সূর্যালোক না থাকলে শিশুরা নিরাপদ থাকবে।
যোদ্ধা পাইলটের নিরাপত্তা
উজ্জ্বল সূর্যালোকে অনেক মানুষ হাঁচি দিতে শুরু করে। এই রিফ্লেকশনের কারণ জানা যায়নি। যদি যোদ্ধা পাইলটের হাঁচি চেপে বসে, তাহলে বোমাবর্ষণই হোক আর আত্মরক্ষাই হোক, দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। সূর্য যদি সত্যিই একেবারে অস্তে গিয়ে থাকে, তাহলে অনেকেই এতে ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন।
শাকসবজির নিরাপত্তা
গাজরজাতীয় সবজির পাতায় ফুরোকুমারিনস নামের কেমিক্যাল সৃষ্টি হয়, তা সূর্যালোকের সাথে প্রতিক্রিয়ায় ফার্নটোফটোডোমাটাইটিস ব্যাধি সৃষ্টি করে। কিন্তু সূর্য অন্ধকার হয়ে থাকলে এই রোগমুক্ত থাকা যাবে।
এ গেল কিছু সুফলের কথা। কুফলের প্রশ্নে এটুকু বলাই যথেষ্ট- পুরো পৃথিবী অন্ধকার হবে, সমস্ত পানি বরফ হয়ে যাবে, সূর্যকে প্রণাম করার মতো একজন পূজারিও বেঁচে থাকবেন না। সাধারণ মানুষ তো নয়ই।