অস্পষ্ট ৩রা নভেম্বর-৭ নভেম্বর, ১৯৭৫: শিশুর স্মৃতি থেকে
ঘুম ভেঙে দেখি
আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমার বয়স ১০ বছর। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়া ছাড়া তেমন বড় কোন ঘটনার কথা মনে নেই। পরে কয়েকটি রাতের কথা স্মৃতিতে হালকা হালকা মনে থাকলেও, তেমনভাবে মনে ছিল না। এখন যে ঘটনার কথা বলতে চাইছি, এটা সেই রাতেরই একটি ঘটনা। এই ঘটনার কী গুরুত্ব, কতটা গুরুত্ব, বাঙালি জাতির ইতিহাসে এর নেতিবাচক প্রভাব কী হতে যাচ্ছে, এসবের কিছুই বুঝতাম না তখন।
ঘটনার দিন-তারিখও আমি সেসময় ঠিক জানতাম না, পরে আব্বার কাছে শুনে সব বুঝতে পেরেছি। শুধু মনে আছে বেশ রাতে, নাকি খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আব্বা, আম্মা আর আমি বিছানা ছেড়ে উঠলেও, ঘরের বাতি জ্বালানো হলো না। আব্বা, আম্মা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে, আর ফিসফিস করে কথা বলছে। আসলে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর, আমরা সবকিছুতেই উদ্বিগ্ন থাকতাম। কখন যে কী ঘটে যাবে এই আতংকই আমাদের পরিবার, বিশেষ করে আব্বাকে তাড়া করে ফিরতো। ছোট হলেও চারিদিকের অস্বস্তিকর অবস্থাটা আমিও বুঝতাম।
অন্ধকারে আমিও ওদের সাথে না বুঝেই জানালা দিয়ে দেখেছিলাম। সামনে ফাঁকা মাঠ থাকায় রাস্তার আলোতে কিছু কিছু দেখা যাচ্ছিল। অস্পষ্টভাবে মনে করতে পারি আসাদগেট নিউ কলোনির বড় মাঠটির পাশের বা এখনকার আড়ংয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে ২/১টি গাড়ি বারবার আসা-যাওয়া করছিল। আব্বা বারবার বলছিলো কেন অসময়ে, ভেতরের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে? (তখনকার সময়ে দিনের বেলাতেই ঢাকা শহরে হাতেগোনা কিছু গাড়ি চলতো)। আমার মনে হচ্ছিল আব্বা আম্মা কেন এভাবে আলো নিভিয়ে জানালা দিয়ে দেখছে? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মনে আছে আব্বা পরদিন আম্মাকে বলল, আমরা রাতে যে গাড়ি দেখেছিলাম, তা মনে হয় খালেদ মোশাররফের গাড়ি ছিল। ওনাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সাথে নিহত হয়েছেন আরো অনেকে।
ক'দিন থেকেই গুমোট পরিবেশ
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকেই একটা গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছিল। কিন্তু কেন, কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে, সেটা বোঝার বয়স বা ধারণা কিছুই আমার ছিলনা। শুধু বুঝতে পারছিলাম চারদিকে কেমন যেন একটা সুনসান নীরবতা। আমাদের কলোনিতে সেসময় বসবাসরত জাসদপন্থী লোকজন ও মুজিব বিরোধীদের দেখতাম গলা উঁচু করে গল্প করছে।
অনেক পরে, পড়াশোনা করে এবং আব্বার কাছ থেকে বাস্তব গল্প শুনে বুঝতে পেরেছি সেই সময়টা ছিল--- ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত যা ঘটেছিল, তা ছিল খুবই অনভিপ্রেত, শোকাবহ ঘটনা। সাধারণ মানুষ কেউই স্পষ্টভাবে বলতে পারেননা বা জানেননা, ঠিক সে সময়টাতে কে, কী ভূমিকা পালন করেছিল? মীরজাফরের সংখ্যা ছিল কতজন? কতগুলো মানুষের পদচারণা এবং কার্যক্রম ও বেশ কিছু ঘটনা নিয়ে রহস্য থেকেই গেছে।
যদিও বেশ কয়েকটি বই আছে এই সময়টাকে ঘিরে। কিন্তু তাও রহস্য ভেদ হয়নি । আমার আব্বা শামস উল হুদা সাহেব তখন সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। ফলে অনেক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। আমি বড় হওয়ার পর আব্বাকে বহুবার বলেছি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনাগুলো নিয়ে বই লিখতে, যাতে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে একটি বই থাকে। আব্বা ভেবেছিল লিখবে, কিন্তু হঠাৎ চলে যাওয়ায় আর লেখাও হয়ে উঠেনি।
কেন ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থান
বড় হওয়ার পর আমি বিভিন্ন সময় আব্বার কাছ থেকে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। যেমন ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনাবাহিনীতে 'চেইন ইন কমান্ড' পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তিনি তাদের বঙ্গভবন থেকে সরাতে চেয়েছিলেন এবং তা পেরেছিলেনও। বলা যায়, ঘাতকদের বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠ। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে এসময় বন্দি করা হয়েছিল। জেনারেল খালেদ মোশাররফ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ফসল ঘরে তুলতে পারেননি।
খালেদ মোশাররফ ভারতীয় হাইকমিশনারকে কেন ফুল দিতে দেননি
অভ্যুত্থানের পরে খালেদ মোশাররফকে অনেকে ভারতীয় দালাল বলে প্রচার করেছে, যদিও সেনাবাহিনীর অধিকাংশই তা মনে করেনি। এটা ছিল পাকিস্তানপন্থী ও আওয়ামী বিরোধী রাজনীতিবিদদের একটি প্রচারণা। এটা যে প্রচারণা ছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিচের ঘটনার মাধ্যমে।
আব্বার কাছ থেকেই শুনেছি, জাতীয় চার নেতার মরদেহ যখন জেল থেকে বের করে আনা হয়, তখন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার মুক্তিযুদ্ধের এই মহান নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাদের মরদেহের ওপর ফুলের তোড়া অর্পণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খালেদ মোশাররফ তাতে রাজি হননি। তিনি ভারতের দালাল হলে তো না করার কথা ছিল না।
১৯৯১-তে এসে কর্ণেল রশীদের বয়ান
ফ্রিডম পার্টির নেতা কর্ণেল রশীদ জিয়া সাহেবের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছিল ১৯৯১-তে তাদের এক সংবাদ সম্মেলনে। জিয়ার বিরুদ্ধে সেই সংবাদ সম্মেলন সে কেন করেছিল, সে আলোচনায় না গেলেও তার আনা অভিযোগগুলো আলোচনার দাবি রাখে। অভিযোগগুলো হলো-
১. জিয়া সাহেব মুজিবকে হত্যা করার কথা আগে থেকেই জানতেন
২. মুজিবকে মারার পর জিয়া সাহেব নিজেই রাষ্ট্রপ্রধান হতে চেয়েছিলেন
৩. জিয়া সাহেব চার নেতা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন
৪. জিয়া সাহেবই ৩ নভেম্বরের ক্যু ঘটিয়েছেন। তার সাথে ছিলেন খালেদ মোশাররফ।
তবে তার এসব দাবির সত্যাসত্য বিচার করার জন্য যাদের দরকার ছিল, তারা কেউ তখন বেঁচে ছিলেননা।
আব্বা মারা গেছেন ১৯৯২ সালে। তিনি জোরালোভাবে বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন এই দেশে একদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার ও জেল হত্যার বিচার হবেই। তখন হয়তো অনেক না জানা কথা বেরিয়ে আসবে। আব্বা চলে যাওয়ার অনেক পরে তার কথা সত্য হয়েছে।
কিছু প্রশ্ন: কিছু উত্তর
আমার মনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, কেন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে মারা হলো? কেন ৩রা নভেম্বর জেলে ৪ নেতাকে হত্যা করা হলো? কেন ঐ একই তারিখে খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটালেন এবং ৭ নভেম্বর কর্ণেল আবু তাহের পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কেন ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিলেন?
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান নিয়েও আব্বার কাছ থেকে শোনা আরো কিছু তথ্য তুলে ধরার ইচ্ছা আছে পরবর্তীতে। কারণ আমার দেখা 'ঐ গাড়িগুলোর যাতায়াতের' সাথে মিলে যাচ্ছে ৭ নভেম্বরের আরো কিছু ইতিহাস, আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর।
আরো কিছু স্মৃতি
এএইচএম কামারুজ্জামান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার নেতাদের একজন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন। আমার বন্ধু বন্দনা লিখেছে উনি ছিলেন রুমি আপার বাবা, ওর সেজদির বন্ধু। আজিমপুর কলোনিতে ইডেন কলেজের ঠিক উল্টো দিকের বিল্ডিংটিতে বন্দনাদের বাসায় রুমি আপা প্রায়ই আসতো ওদের বাসায়।
সেজদির সাথেই বন্দনা রুমি আপাদের– বিশাল লনওয়ালা বাসায় যেতো শুধু দোলনাটাতে চড়ার জন্য। বারান্দায় ইজি চেয়ারে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে বসে থাকতেন রুমি আপার বাবা। কি যে শান্ত আর সৌম্য ছিল তার চেহারা!
এই চার নেতার দেশাত্মবোধ, সততা, পারিবারিক শৃঙ্খলা, সহজ সরল অমায়িক ব্যবহার ছিল শিক্ষণীয়। বন্দনা বলেছে, রুমি আপার খালার বিয়েতে পোলাও কোর্মার আয়োজন না করে, করা হয়েছিল পরোটা, মিষ্টির বাবস্থা। কারণ, দেশে তখন চরম খাদ্যাভাব চলছে। দেশের মানুষ কষ্টে আছে বলেই ছিল সীমিত আয়োজন।
বাবার জন্য জেলখানায় নিয়ে যাওয়া খাবার ফেরত এলো
৩রা নভেম্বর, ১৯৭৫ জেল হত্যার সেই ভয়াবহতম দিন ! মুহূর্তেই ওলট পালট হয়ে গেল রুমি আপাদের সংসার ও দেশ। জেলখানায় বাবার জন্য খাবার নিয়ে গিয়ে ফেরত আসতে হয়েছিল ৩রা নভেম্বরের পর থেকে তিন দিন। চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল ৩ তারিখেই। কিন্তু খাবার নিয়ে গেলে জেল কর্তৃপক্ষ বলতো তাদের জেল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হত্যার কথাই যেখানে গোপন রাখলো, সেখানে মরদেহ দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না। মরদেহ দেয়া হয়েছিল ৩ দিন পরে। অথচ ঐ ৩ দিনই বাবার জন্য কারাগারে ওনারা ভাত নিয়ে গিয়ে গিয়েছিল।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন