ধর্মঘটে ৩৬ কোটি ডলার লোকসানের আশঙ্কা রপ্তানিকারকদের
বাস ও লঞ্চ মালিকরা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী ডাকা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিলেও সেটি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতি।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহারসহ তিন দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য চলমান কর্মবিরতি অব্যাহত রাখবে বলে তারা জানিয়েছে।
এদিকে চলতে থাকা ধর্মঘটের ফলে ৩৬০ মিলিয়ন বা ৩৬ কোটি ডলারের পণ্য আটকে রয়েছে রপ্তানিকারকদের।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোঃ শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "ধর্মঘটে বন্দরে অতিরিক্ত তিনদিন পড়ে থাকার কারণে আমাদের আড়াই লাখ ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে।"
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, একটি জাহাজকে সাধারণত বন্দরে এক দিন বেশি অবস্থানের জন্য ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার দিতে হয়; এটি কন্টেইনারের আকারের উপর নির্ভর করে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি বলেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে বাধ্য হয়ে রপ্তানিকারকদের বিমানের ফ্রেইটে পণ্য পাঠাতে হতে পারে; ফলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কাই করছেন তারা।
শহীদুল্লাহ আরও বলেন, কোনো রপ্তানিকারক ওয়াশিং প্ল্যান্ট এবং এমব্রয়ডারি ইউনিটে পণ্য স্থানান্তর করতে পারে নি; একই সময়ে কারখানাগুলোয়ও এক্সেসরিজের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, কাঁচামাল সরবরাহের ঘাটতিতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি পণ্যের চালান নিয়ে চিন্তিত।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কমপক্ষে তিনজন রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়েছেন যে তাদেরকে পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফেরত এনে বিমানযোগে পাঠাতে হবে।
"যদি কেউ জাহাজ বা ডেডলাইন মিস করে, তাদের বিমানযোগেই পণ্য পাঠাতে হয়," যোগ করেন তিনি।
হাতেম জানান, একটি পণ্যের রপ্তানিমূল্যের ৫৫% এয়ার ফ্রেইটে খরচ হয়ে যায়।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার, বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতুর বর্ধিত টোল প্রত্যাহার এবং সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলো কর্তৃক পণ্যপরিবহন যানের ওপর 'টোলের নামে চাঁদাবাজি' বন্ধের দাবিতে ধমর্ঘট চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, প্রাইম মুভার পণ্যপরিবহন মালিক সমিতি।
রোববার বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন সংগঠনটির অতিরিক্ত মহাসচিব আব্দুল মোতালেব।
তিনি বলেন, "এই তিন দফা দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত সারাদেশে পণ্য পরিবহনযান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।"
তিনি আরও বলেন, "যারা আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পণ্যপরিবহন ভাড়া ১৫ হাজার টাকা দিতেন, তেলের দাম বাড়ায় তাদের থেকে ১৮ হাজার টাকা নিতে হবে। কিন্ত তারা দিবেন না, কারণ আমাদের ভাড়া নির্ধারিত করে দিয়েছে সরকার, তাই তেলের দাম প্রত্যাহারই আমাদের মুক্তির উপায়।"
সংগঠনটির এ নেতা বলেন, "এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা করা হয়নি, তাই আমরা বাধ্য হয়েছি এই আন্দোলন অব্যাহত রাখতে।"
ধর্মঘটে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) আটকা পড়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার রপ্তানিপণ্য।
আইসিডি থেকে লোডিংয়ের জন্য বন্দরে কোনো রপ্তানিপণ্য প্রবেশ করে নি।
বন্দর থেকে বের হয়নি পণ্যবাহী কোনো কন্টেইনারও।
শুক্র থেকে রোববার পর্যন্ত বন্দরে গাড়ি প্রবেশ না করায় জাহাজীকরণের অপেক্ষায় আইসিডিগুলোতে আটকে আছে প্রায় ৯ হাজার ৭০০ টিইইউএস (টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) পণ্য।
এর মধ্যে বেশিরভাগ পণ্যই তৈরি পোশাক (আরএমজি)।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) জানায়, প্রতি টিইইউ কন্টেইনারে প্রায় ৪০ লাখ টাকার রপ্তানিপণ্য থাকে। সেই হিসাবে আইসিডিগুলোতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য আটকে রয়েছে।
বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, 'শুক্রবার রাতে কিছু কন্টেইনার জাহাজীকরণ হলেও শনি এবং রবিবার কোনো কন্টেইনার জাহাজীকরণ হয়নি। সেগুলো বর্তমানে ১৯টি আইসিডিতে রয়েছে।'
আমদানি করে আনা কাঁচামালের সরবরাহ বুঝে নিতে না পারায় দেশের শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কারখানা মালিকরা।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ডেলিভারি পেতে বিলম্ব হওয়ায় পণ্য রপ্তানির লিড টাইম ইতোমধ্যে কমে গেছে তিন দিন। এ কারণে বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাক শিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা।
বিজিএমইএর ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, হাইওয়ে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় গত শনিবার রাতে ঢাকা থেকে বিভিন্ন পোশাক কারখানার রপ্তানিপণ্য চট্টগ্রামের আইসিডিগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনেরর পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ না হওয়ায় ক্রেতার হাতে শিডিউল অনুযায়ী পণ্য পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'রবিবার পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার না হলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে।'
এদিকে বন্দরে ডেলিভারি বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অভ এন্ট্রি দাখিল স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ফার্স্ট জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়নের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে যাবতীয় কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলছে। পরিবহন ধর্মঘট উঠে গেলে যাতে দ্রুত পণ্য ডেলিভারি নেওয়া যায়, সেজন্য শুল্কায়ন বিষয়ক যাবতীয় কাজ আমরা সম্পন্ন করছি।'
বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে সরকার বুধবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করে।
এর প্রতিবাদে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা ভাড়া বৃদ্ধি অথবা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেয়।
রোববার বাস মালিকদের সাথে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং লঞ্চ মালিকদের সাথে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বাড়তি ভাড়ার ব্যাপারে সরকারের সবুজ সংকেতের পর বাস ও লঞ্চ মালিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন।
ভোমরা বন্দরে আটকা ৩০০ ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক
ধর্মঘটের প্রভাবে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে আটকা পড়েছে ৩০০ ভারতীয় ট্রাক। বাংলাদেশি ট্রাকের অভাবে আমদানিকৃত ভারতীয় ট্রাক থেকে পণ্য পরিবহন করতে পারছে না আমদানিকারকরা। এতে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোমরা বন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম জানান, "শনিবার (৬ নভেম্বর) ভারত থেকে ৪০০ পণ্যবাহী ট্রাক দেশে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ১০০ ট্রাক ডেলিভারি দেওয়া গেছে। বাকি ৩০০ ভারতীয় ট্রাকই বন্দরে আটকা পড়ে রয়েছে।"
আমদানিকৃত ট্রাক থেকে পণ্য পরিবহন করতে বাংলাদেশি ট্রাকের সংকটের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে সেহেতু দ্রুত সময়ের মধ্যে ধর্মঘট প্রত্যাহার না হলে ধীরে ধীরে এর পরিমাণ আরও বাড়বে।
ভোমরা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কার্যালয়ের সহকারি কমিশনার আমির মামুন বলেন, "সকাল ৯টা থেকে বন্দরের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মে শুরু হয়েছে। শনিবার ৪০০ পণ্যবাহী ট্রাক দেশে প্রবেশ করেছে। তবে বাংলাদেশি ট্রাকের সংকট থাকায় আমদানিকারকরা পণ্য পরিবহন করতে পারছেন না বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।"
আখাউড়া স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক
দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে ট্রাক ধর্মঘটের তেমন প্রভাব পড়েনি।
গতকাল রোববারও (৭ নভেম্বর) এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিলো। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে গড়ে ১০ লাখ ডলার মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, "ধর্মঘটের প্রথম দিন (শুক্রবার) বন্দরে সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। পরদিন শনিবার থেকে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। তবে ট্রাক ধর্মঘটের কোনো প্রভাব বন্দরে পড়েনি।"