স্টিকার-রূপী স্কিন প্যাচই কি কোভিড টিকার ভবিষ্যৎ
ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় ৪৯ শতাংশ জনসংখ্যা এরই মধ্যে কোভিডের অন্তত একটি ডোজ পেয়েছেন। তবে কোটি কোটি মানুষ এখনও অপেক্ষা করছে টিকার জন্য।
২৮ অক্টোবর পর্যন্ত আফ্রিকার ৫৪টি দেশের মধ্যে মাত্র পাঁচটি দেশে জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশ টিকার আওতায় এসেছে। তবে সিরিঞ্জের ঘাটতি এবং টিকা হিমায়িত অবস্থায় রাখার সুবিধার অভাব প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে।
তবে বিজ্ঞানীরা সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা যায় এবং সিরিঞ্জের প্রয়োজন হয় না এমন টিকা আবিষ্কারের লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল কোভিড-১৯-এর জন্য একটি স্কিন প্যাচ টিকা তৈরি করেছে। স্টিকারের মতো ছোট, গোলাকার এই প্যাচ হাতের উপরের অংশে সাময়িকভাবে সাঁটানোর মাধ্যমে দেওয়া হবে এই টিকা।
প্লাস্টিকের এই প্যাচ আমাদের আঙুলের নখের চেয়েও ছোট। এর মধ্যে থাকবে পাঁচ হাজার অতিক্ষুদ্র সূচ-রূপী অভিক্ষেপ, যেগুলো ত্বকে প্রবেশ করবে এবং ত্বকের স্তরগুলোতে টিকা জমা করে। এই প্লাস্টিকের প্যাচ কোনো ব্যথার উদ্রেক করবে না।
এই প্রযুক্তিটি মাইক্রোনিডল প্যাচ হিসেবে পরিচিত। ইনসুলিনের মতো অনেক ওষুধের ক্ষেত্রেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
কোভিড রোধে সর্বশেষ এই টিকা এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করা হয়েছে।
করোনার স্পাইক প্রোটিনকে স্থিতিশীল অবস্থায় পাউডারে পরিণত করার জন্য বিজ্ঞানীরা নাইট্রোজেন জেট-ভিত্তিক শুকানো প্রক্রিয়া ব্যবহার করে টিকা তৈরি করেছেন। এরপর গুঁড়ো স্পাইক প্রোটিনগুলো প্যাচের উপর লেপে দেওয়া হয়েছে।
ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ টিকা সাধারণ তাপমাত্রায় এক মাস পর্যন্ত, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত কার্যকর থাকে।
ইঁদুরের মাঝে হওয়া পরীক্ষায় দেখা গেছে, সুই-সিরিঞ্জের টিকার চেয়ে কোভিডের বিরুদ্ধে বেশি সক্রিয় অ্যান্টিবডি তৈরি করে এই টিকা।
এই টিকা নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধের লেখক ও কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড মুলার বলেন, "আমরা দুর্দান্ত প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।"
জর্জিয়া টেকের সেন্টার ফর ড্রাগ ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ডেলিভারির ডিরেক্টর মার্ক প্রসনিটজ বলেন, "টিকা দেওয়ার জন্য ত্বক বেশ ভালো এক জায়গা। আমাদের ত্বক হলো শরীর এবং বাইরের বিশ্বের জন্য ইন্টারফেস, তাই এটি সবসময়ই প্যাথোজেনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। যেকারণে রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া বাড়ানোর গুরুত্ব বুঝে ত্বক।"
প্রাণীদের উপর পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যান্য সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে এরকম ত্বকের টিকা পেশীতে ইনজেকশন দেওয়া প্রচলিত টিকাগুলোর তুলনায় বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম।
তবে অন্যান্য টিকার মতো এই প্লাস্টিক প্যাচও আপনার হাতে ব্যথা করে দিতে পারে। কারণ এর সঙ্গে কিছু রোগ প্রতিরোধকারী পদার্থ আপনার ত্বকে প্রবেশ করবে। প্যাচ তুলে ফেলার পর হাতের ওই অংশ লালাভ হয়ে যেতে পারে, যা সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে চলে যায়।
তবে সিরিঞ্জের টিকার চেয়ে নিঃসন্দেহে বেশি আরামদায়ক এই টিকা। শিশু থেকে বৃদ্ধ, জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সূচ ভয় পায়। সিরিঞ্জের ভয়েই টিকা থেকে দূরে থাকছে অনেকে। তাদের জন্য লাইফলাইন হয়ে আসতে পারে এই টিকা।
ভীতি ছাড়াও সিরিঞ্জের টিকা আরও নানান কারণে অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে। এবছর বিশ্বব্যাপী টিকা বিতরণ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে টিকা-বিরোধী আন্দোলনও হয়েছে। এই স্টিকার-রূপী প্যাচ টিকা-বিরোধীদের সামনেও একটি বিকল্প এনে দিবে।
তবে, এই প্লাস্টিক প্যাচের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে মজুত ও বিতরণে এর সহজলভ্যতা।
করোনা টিকার স্পাইক প্রোটিনের নকশা করতে সাহায্য করা টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত জীববিজ্ঞানী জেসন ম্যাকক্লেলান বলেন, "এমআরএনএ কোভিড টিকাগুলোর তুলনায় এটির সুবিধা বেশি। কেননা এটি সংরক্ষণের জন্য কম তাপমাত্রার প্রয়োজন নেই।"
তিনি আরও বলেন, হিমায়িত অবস্থায় মজুদ করার প্রয়োজন না থাকায় দরিদ্র দেশগুলোয় যেখানে ফ্রিজারের ব্যবস্থা করার জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, সেসব দেশে এই টিকা আশীর্বাদ হয়ে আসবে।
তবে এ টিকা বাজারে আসতে এখনও কয়েক বছর লাগতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
অনেক বিশেষজ্ঞই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, কোভিড একসময় মৌসুমি ফ্লুয়ের মতো হয়ে যাবে এবং প্রতি মৌসুমেই আমাদের বুস্টার ডোজ নিতে হবে। তাই সম্ভাবনা আছে, সহজলভ্য ও স্থিতিশীল এই স্কিন প্যাচ টিকাই সবার পছন্দের টিকা হয়ে উঠবে।
- সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন।