ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ই-ডেটাবেজ করবে এসএমই ফাউন্ডেশন
সঠিক পরিকল্পনার জন্য ডেটা বা পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশের অর্থনীতির 'লাইফ লাইন' হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) সঠিক কোনো ডেটাবেজ নেই। যার ফলে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখা এসএমই উদ্যোক্তাদের নেই সঠিক হিসাব। এ কারণে সঠিক পরিকল্পনা করা যাচ্ছে না মনে করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে এসএমই খাতের উন্নয়নে কাজ করা এসএমই ফাউন্ডেশন।
অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন-এটুআই এর সহায়তায় অনলাইন বা অ্যাপসের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসএমইদের ই-ডেটাবেজ তৈরি করবে ফাউন্ডেশনটি। ডেটাবেজ তৈরির এই প্রক্রিয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে শুরু হবে। এসএমই খাত সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে এ বিষয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের (ইউডিসি) মাধ্যমে সারাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের তথ্য সংগ্রহ করে একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ প্রণয়ন করবে ফাউন্ডেশন।
সঠিক ডেটাবেজ করা সম্ভব হলে এসএমই খাতের উন্নয়নে সরকারের প্রণোদনা বা সুবিধা প্রদান সহজ হবে। পাশাপাশি এই খাতের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা করাও সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে ৭৮.১৮ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, যার ৯৯.৯৩% প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই)। আর ০.০৭ শতাংশ বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আট বছরে সিএমএসএমইর সংখ্যাও বেড়েছে। তবে এই উদ্যোক্তাদের একটি বড় হিসাবের বাইরে থেকে গেছেন। যার ফলে যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
যেমন: স্বল্পসুদে সরকারের প্রণোদনা বিতরণে সমস্যা পড়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন। ঋণ বিতরণে বিভিন্ন এসোসিয়েশন সদস্যদের জন্য যে চাহিদা পাঠিয়েছে, তার বড় অংশ প্রণোদনার বাইরে ছিল। কারণ তারা কোনো এসোসিয়েশনে সদস্যভুক্ত হয়নি।
জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির সভাপতি ও ডেটাবেজ প্রণয়ন কমিটির সদস্য মির্জা নুরুল ঘানি শোভন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন যে পরিসংখ্যান ধরা হয়, তার চেয়ে এসএমইদের সংখ্যা অনেক বেশি। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ৭৮ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলা হলেও, বর্তমানে শুধু সিএমএসএমই'র সংখ্যাই হবে এক কোটির বেশি।"
তিনি বলেন, "এসএমই খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সঠিক ডেটাবেজ নেই, যার ফলে পরিকল্পনাগুলোও অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। কাজেই এসএমই ডেটাবেজ প্রণয়নে একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ প্রয়োজন। এসএমই খাতের উন্নয়নে সঠিক ডেটাবেজ প্রণয়ন করা খুব জরুরি।"
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়্যারম্যান ড. মো. মাসুদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এসএমইদের আপ-টু-ডেট ডেটা নেই, যার আছে, তা খুব পুরনো। তবে এই খাতটির উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনার জন্য পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ প্রয়োজন। কিন্তু ফাউন্ডেশনের জনবলসহ আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও প্রয়োজনের তাগিদে অনলাইন বা অ্যাপসের মাধ্যমে ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।"
তিনি বলেন, "অর্থনীতির কলেবর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। যার মধ্যে এসএমই খাতেরও কলেবরও বেড়েছে। পরিসর বড় হওয়ার সঙ্গে নতুন নতুন উদ্যোক্তাও গড়ে উঠেছে কিন্তু সঠিক সংখ্যা জানি না, যাতে সঠিক পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস সাধারণত এসব বিষয়ে জরিপ বা শুমারি করে। মাঠ পর্যায়ে তাদের সক্ষমতাও বেশি। তবে এসএমইদের নিয়ে কোনো জরিপ বা শুমারি করেনি, এটা এখন সময়ের দাবি। এসএমই নিয়ে তিনি একটি জরিপ পরিচালনার অনুরোধ জানান।
কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ই-ডেটাবেজ প্ল্যান
এসএমই ফাউন্ডেশন মনে করছে, অর্থনীতির কলেবর বাড়ার সঙ্গে বড় হয়েছে এসএমই খাত। উদ্যোক্তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। তারা ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটাটিকসের (বিবিএস) অর্থনৈতিক সমীক্ষার শিল্প-প্রতিষ্ঠানের তথ্য ধরে পরিকল্পনা করছে। এই সময়ে অর্থনীতির পরিধি বাড়ার সঙ্গে এসএমই খাতেরও পরিসর বেড়েছে।
ফাউন্ডেশন মনে করছে, এসএমই উদ্যোক্তাদের আপ টু ডেট ডেটা না থাকায় সঠিক পরিকল্পনা করা যাচ্ছে না। সঠিক ডেটাবেজ না থাকায় সরকারের প্রণোদনা বা বিভিন্ন সহায়তাও উদ্যোক্তাদের সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছে।
মূলত, করোনা মহামারীর সময় ক্ষতিগ্রস্থ উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে ফাউন্ডেশন।
যার জন্য এটুআই-এর সহায়তায় এসএমই'র একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ফাউন্ডেশন।
দেশের একটি উপজেলাকে পাইলট প্রকল্প হিসাবে নিয়ে ই-ডেটাবেজের কার্যক্রম শুরু হবে। পরবর্তীতে সারাদেশে এই কার্যক্রম শুরু হবে।
প্রতিটি জেলা-উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবে, যা একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজে সংরক্ষিত থাকবে। সেই ডেটাবেজের উপর ভিত্তি করে এসএমই উন্নয়নে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করবে ফাউন্ডেশন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়্যারম্যান ড. মোঃ মাসুদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এ ধরনের জরিপ করার কোনো প্রয়োজনীয় সাপোর্ট নেই। সনাতন পদ্ধতিতে জরিপ করার মতো জনবলও নেই। বিদেশী একটি সংস্থার সহায়তা ও অর্থায়নে সারাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের ডিরেক্টরি তৈরির অভিজ্ঞতা আছে।"
তিনি বলেন, সফলভাবে এই জরিপ সম্পন্ন করার কারণে সারাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ই-ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি, তবে কভিডের কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যেই পুরো কার্যক্রম শুরু হবে।"
২০১৩ সালে বিবিএস'র অর্থনৈতিক শুমারি
জাতীয় পর্যায়ে প্রধান শিল্পগুলোর প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, প্রকার এবং কার্যক্রম সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্যের জন্য, ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক শুমারি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
শুমারিতে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসা, শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ, বেসরকারি খাতের গঠন এবং ছোট এলাকার তথ্য রয়েছে।
৮ বছরের আগের এ শুমারি অনুযায়ী, দেশে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্পসহ ৭৮.১৮ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এরমধ্যে কুটির শিল্প রয়েছে ৬৮.৪৩ লাখ যা মোট প্রতিষ্ঠানের ৮৭.৫২ শতাংশ। এছাড়াও মাইক্রো ১.৩৩ শতাংশ, ক্ষুদ্র ১০.৯৯ শতাংশ এবং বৃহৎ শিল্প হয়েছে ৫২৫০ টি বা ০.০৭ শতাংশ।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই খাতে ২.৪৫ কোটি মানুষ যুক্ত আছে যা ২০০১, ২০০৩ সালেও ১.১২ কোটি ছিল।
জাতীয় শিল্পনীতি-২০১৬ অনুযায়ী, বৃহৎ শিল্প হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠান, যার জমি ও কারখানা ভবন ব্যতীত স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৫০ কোটি টাকার বেশি এবং তৈরি পোশাক ও শ্রমঘন শিল্প ব্যতীত জনবল ৩০০ জনের বেশি।
আর মাঝারি শিল্পের সম্পদ ১৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার কম এবং জনবল ১২১-৩০০ জন ও ক্ষুদ্র শিল্পের সম্পদ ৭৫ লাখ-১৫ কোটি টাকা এবং শ্রমিক ৩১-১২০ জন।
মাইক্রো শিল্পের সম্পদ ১০-৭৫ লাখ টাকা এবং জনবল ১৬-৩০ জন এবং কুটির শিল্পের সম্পদ ১০ লাখ টাকার কম। এই শিল্পে পরিবারের সদস্য প্রাধান্যভুক্ত এবং পারিবারিক সদস্যসহ মোট জনবল সর্বোচ্চ ১৫ জন।
- মূল প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: E-database for SMEs on the card