এক দশকে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বেড়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টন
‘‘আগে ইলিশ পেতাম খুব অল্প। কোনোরকম সংসার চালাতাম। মাছের আকার ছিল ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির মধ্যে। কিন্তু এখন মাছ বেশি ধরা পড়ছে। ইলিশের আকারও এক কেজির চেয়ে বেশি। ফলে আগের চেয়ে আমি এখন অনেক বেশি স্বচ্ছল।’’
সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী ঘাটে এ কথা জানান জেলে কৃষ্ণচন্দ্র মালো। তিনি বলেন, ‘দশ বছর আগের চেয়ে এখন দ্বিগুণ মাছ পাই। তবে ৬৫ দিন জাল বাইতে পারি না। জাটকা ধরতে পারি না ছয়মাস। মা ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তবুও নেই সংকট। এখন জেলেরা ভাত খেয়ে ভালো আছে।’
শুধু কৃষ্ণচন্দ্র মালো নয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল জেলের বক্তব্য প্রায় এমনই। সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর চট্টগ্রামের দেয়া হিসাব মতে, গত এক দশকে দেশে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বেড়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ৪৩ টন। ২০০৮-০৯ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আহরিত মাছের হিসাব বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ওই বছরগুলোতে মাছের আহরণ ছিল যথাক্রমে পাঁচ লাখ ১৪ হাজার ৬৪৪ টন ও ছয় লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭ টন। গত এক দশকে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ২৭.২১ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘সরকার বছরের ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে। এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ।’
তবে আহরিত সম্পদ নিয়ে সন্তুষ্ট নন তিনি। ড. শাহাদাত বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ ধরছে। কিন্তু আধুনিক দেশগুলো সমুদ্র থেকে মাছ ধরার ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেকদূর এগিয়েছে। তাদের আর আমাদের সম্পদের পরিমাণ একই হলেও আহরণে তারা এগিয়ে। এজন্য আমাদেরও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করতে হবে।’
২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর নতুনভাবে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যুক্ত হয়েছে। এরপর সরকার সামুদ্রিক সম্পদ আহরণকে অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করে বছরে ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধসহ একাধিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে। যার ফলে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা।
গত ১০ বছরের উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৪ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হয়েছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার ২৮১ টন, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৩ টন ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৬২০ টন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হয়েছে।
এ ছাড়া ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৯৮৮ টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৫ টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৪৬ টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫২৮ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৬ টন ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭ টন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হয়েছে।
২০১৮-১৯ সালে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ সাড়ে ৭ লাখ টন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরে কর্মকর্তারা। তবে এ তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
এক দশকে এক লাখ ৪০ হাজার টন মাছ আহরণ বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের পরিচালক লতিফুর রহমান বলেন, সরকার ব্লু ইকোনমি নিয়ে পরিপূর্ণ ধারণা দিতে স্থায়ী একটি ব্লু ইকোনমি সেল গঠনের কাজ করছে। এ ছাড়া নৌ-পরিবহন, উপকূলে জাহাজ চলাচল, সমুদ্র বন্দর, জাহাজ নির্মাণ ও পুনর্ব্যবহার, সামুদ্রিক মৎস্য, লবণাক্ততা, উপকূলীয় পর্যটন, জোয়ার-ভাটা থেকে শক্তি, ভূমি পুনরুদ্ধার, সামুদ্রিক সম্পদ জরিপ ও নজরদারি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও গভর্ন্যান্সকে অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার।
বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে ছয় লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭ টন এসেছে সমুদ্র থেকে; যা মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৬ শতাংশ। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ আয় করেছে চার হাজার ৩১০ কোটি টাকা।
বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলার মালিকদের সংগঠন সোনালী যান্ত্রিক মৎস শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকার কঠোরভাবে মৎস্যনীতি বাস্তবায়ন করায় সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে মৌসুমে গড়ে ১৫০ থেকে ২৫০ ট্রলার মাছ নিয়ে চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটে আসতো। এখন মৌসুমে গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রলার মাছ নিয়ে আসছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বছরে ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ, ২২ দিন ইলিশ মাছ ও ৬ মাস জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এই নিয়মের ফলে মাছের আকার বড় হচ্ছে। জালে এখন বড় মাছ ধরা পড়ছে।’
দস্যুতা কমে গেলে আহরণ আরও বাড়তো জানিয়ে বাবুল সরকার বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে ট্রলারে এখনো জলদস্যুরা আক্রমণ করে। জেলেদের সবকিছু ছিনিয়ে নেয় তারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জেলেদের ঘাটে ফিরে আসতে হয়। গভীর সাগরে কোনো জেটি থাকলে সেখানে জেলেরা আশ্রয় নিতে পারতো। এতে করে মৎস্য আহরণের পরিমাণ বাড়তো।’
সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, সামুদ্রিক মৎস্য পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে চিংড়ি। চিংড়ি প্রজাতির মধ্যে রয়েছে বাগদা, চাগা, বাগাচামা, হরিণা, লইল্যা, রুডা। বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের মাছ। সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে আহরিত মৎস্যপ্রজাতির মধ্যে চিংড়ি ছাড়া রয়েছে সার্ডিন, ইলিশ, পোয়া, রূপচান্দা ও দাতিনা ইত্যাদি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ আওয়ার সি’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর আট মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। তার মধ্যে ভারত ও মিয়ানমারও বঙ্গোপসাগর থেকে মৎস্য আহরণ করছে। নানা প্রজাতির মূল্যবান মাছ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণি, ৩৫ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক রয়েছে এই জলরাশিতে।
বাংলাদেশের সমুদ্রে মৎস্যক্ষেত্র রয়েছে ৪টি। সেগুলো হচ্ছে- সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড, মিডল গ্রাউন্ড, সাউথ প্যাচেস ও সাউথ অব সাউথ প্যাচেস।
বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চল রয়েছে ৭১০ কিলোমিটার। সমুদ্রসীমা রয়েছে নয় হাজার ৬০ বর্গ কিলোমিটার। মহীসোপান ২৪ হাজার ৮০০ নটিক্যাল মাইল। সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ৬৯৮ বর্গ কিলোমিটার। এ ছাড়া সম্প্রতি হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে সংলগ্ন তিন হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। দেশে ১৪টি উপকূলীয় জেলা এবং ৪৯টি উপকূলীয় উপজেলা রয়েছে।
বর্তমানে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে ২৫৫টি। ফিশিংয়ে নিয়োজিত আছে ২৩৬টি ট্রলার। এর মধ্যে চিংড়ি ট্রলার ৩৫টি, বটম ট্রলার ৫২টি, মিডওয়াটারে রূপান্তরিত ট্রলার ৬৮টি, মিডওয়াটার ট্রলার ৫৩টি, ট্রায়াল ট্রিপ বটম ২৮টি। এ ছাড়া ইঞ্চিনচালিত ও ইঞ্চিনবিহীন নৌযানের সংখ্যা রয়েছে ৬৭ হাজার ৬৬৯টি।