নাগরিক সুবিধার কথা চিন্তা না করে সমন্বয়হীনভাবে ড্যাপের খসড়া: অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের
ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্পোরেশন (রাজউক) কতৃক প্রণয়নাধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০১৬-২০৩৫ এর খসড়া নগরের মানুষের কথা চিন্তা না করে এবং সমন্বয়হীনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।
শনিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে রাজউক আয়োজিত ড্যাপের খসড়া নিয়ে জাতীয় সেমিনারে তারা এ অভিযোগ করেন।
তাদের মতে, স্বাধীনতার পর দেশের অবকাঠামো পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়নের আগেই নগরীর রাস্তাঘাট হয়ে পড়েছে সরু, নদীনালা, খাল, জলাশয় চলে গেছে দখলদারের কবলে।
ঢাকা শহরের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে মানুষ বেড়েছে কয়েক গুণ। এমন শহরের জন্য ২০১৬ সালে সরকার হাতে নেয় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-ড্যাপ। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও আক্ষেপ নগর পরিকল্পনাবিদদের।
জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন, শুধু রাজউক নয়, সরকারের সব সংস্থারই রয়েছে সক্ষমতার অভাব। শহরের মধ্যেও অনেক জায়গার নিয়ন্ত্রণ অন্যান্য সংস্থার হাতে।
ড্যাপের পরিকল্পনায় দেখা যায়, ২০১১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, তখন ঢাকায় বসবাস করতো প্রায় ১.৫৫ কোটি মানুষ। ২০৩৫ নাগাদ যা পৌঁছাতে পারে প্রায় ২.৬ কোটিতে।
পরিকল্পনায় যুক্ত রাজউকের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার সীমানা ও ব্যাপ্তি অনুযায়ী, চারটি সিটি করপোরেশন (ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ) ও পাঁচটি পৌরসভা যুক্ত হচ্ছে। পৌরসভাগুলো হলো- সাভার, তারাবো, কালীগঞ্জ (আংশিক), সোনারগাঁও (আংশিক) এবং কাঞ্চন (আংশিক)। এতে যুক্ত হবে তিন জেলার ৬৯টি ইউনিয়ন পরিষদও।
ড্যাপের সীমানা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ড্যাপের উত্তরে সমগ্র গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা, দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকা যা ধলেশ্বরী নদী দ্বারা বেষ্টিত, পশ্চিমে সাভারের বংশী নদী এবং পূর্বে কালীগঞ্জ-রূপগঞ্জ যা শীতলক্ষ্যা নদী এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কেরাণীগঞ্জ দ্বারা বেষ্টিত।
ড্যাপে ভূমি ব্যবহার প্রস্তাবনায় ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে নগর ধরা হয়েছে ৬০ শতাংশ এলাকাকে।
রাজউক এলাকায় মোট স্থাপনার ভেতর ৮৪ শতাংশেরও বেশি একতলা ভবন রয়েছে বলে ড্যাপে উল্লেখ করা হয়। আর ড্যাপের এলাকার মধ্যে ৭৬ শতাংশ স্থাপনার উপরে কাঁচা বা আধাপাকা। ৯৫ শতাংশ পরিবারেরই ব্যক্তিগত গাড়ীর মালিকানা নেই।
রাজউকের দেওয়া ড্যাপের তথ্য অনুযায়ী, এলাকাধীন নাগরিকদের প্রায় ৪০ শতাংশ এখনও পায়ে হেঁটে যাতায়াত সম্পন্ন করেন। রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ৬.৪ কি.মি.।
ড্যাপের সুপারিশ অনুযায়ী, পুরাতন ঢাকার ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা, বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে পুরো ঢাকার জন্য সংস্কৃতি বলয় তৈরী করা, রাসায়নিক গুদামসমূহ স্থানান্তর করাসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়।
ড্যাপের প্রস্তাবনায় ২৫,০৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬২৭টি বিদ্যালয় ও ১,৫৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৮৭টি হাসপাতাল তৈরীর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
নতুন করে ৬৫৭.৬৫৮ কিলোমিটারসহ ৩২০৭.৬৬৯ কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়ন প্রস্তাব রয়েছে ড্যাপে। এছাড়া গণশুনানির পরে আরও প্রায় ৩৯৪ কিলোমিটার নতুন রাস্তার প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
এসব পরিকল্পনা নিলেও কারা, কিভাবে এগুলো বাস্তবায়ন করবে এমন কোনো রূপরেখা এর মধ্যে রাখা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
ড্যাপে ঢাকাকে নিয়ে বিশদ আকারে পরিকল্পনা করা হলেও বন্যা এলাকা নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় না মেনেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, "ঢাকায় খালগুলো নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে, কিন্তু এগুলোর পরস্পর যুক্ত করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনার কথা বলা হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, "এ পরিকল্পনা যদি জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বাস্তবায়নের জন্য করা না হয়, তবে 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার' এর মতো অবস্থা হবে। দ্রুত ড্যাপের সংশোধন করে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শেষ করা হোক।"
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন-ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ, নিজেদের মতো করে কোনো পরিকল্পনা অনুমোদন বা বাস্তবায়ন করতে পারে না। ফলে সমন্বয়ের বিষয়টি পর্যালোচনা করেই ড্যাপ চূড়ান্ত করা উচিত।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নূরুল হুদা বলেন, "আগের ড্যাপেও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, এটাতেও আছে। এগুলো সংশোধন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের দিকে আগানো দরকার। ঢাকার ৫৪টি সেবা সংস্থার নিজেদের মধ্যে সমন্বয় নেই। এটার পরিবর্তন জরুরি।"
ড্যাপের নতুন প্রস্তাবনা নিয়ে যেন নাগরিকদের হয়রানি না হয় এবং সবার প্রস্তাবনার ভিত্তিতে সংশোধন করে শিশু, নারী এবং বয়স্কদের কথা চিন্তা করে যেন উন্নয়ন কাজ করা হয়, সে প্রস্তাব রাখেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম।
ড্যাপ সফল করতে হলে রাজউক কি নিয়ন্ত্রক সংস্থা নাকি বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেটি আগে নিশ্চিত করা জরুরি উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভি বলেন, "ড্যাপ বাস্তবায়নের আগে ড্যাপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অবস্থান নিশ্চিত করুন।"
তিনি আরও বলেন, "রাজউকের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সক্ষমতার চেয়ে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। আমি বলবো নগর প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়িয়ে সেখানে রাজউককে যুক্ত করা উচিত।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, "তড়িঘড়ি করে এ ড্যাপ পাশ করলে বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা দেখা যাবে। নাগরিকদের সিটি কর্পোরেশন অনেক সুবিধাও দিয়ে থাকে কিন্তু তার অনেক কিছুই ড্যাপে উল্লেখ নেই।"
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, "২০৩৫ সালে ঢাকা কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা বিবেচনা করে আমরা প্ল্যান সাজিয়েছি। কোনো এলাকায় যেন সুযোগ-সুবিধার তুলনায় অধিক জনবসতি তৈরি না হয় সেজন্য আমাদের পরিকল্পনায় রাস্তার প্রশস্ততার আলোকে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে।"
সভাপতির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, "আমরা বিকেন্দ্রীকরণের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আবাসিক এলাকায় কোনো ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন থাকবে না। আমরা সুউচ্চ ভবনের দিকে নজর দিচ্ছি। যেখানে ভবন হবে সেই ভবনের আশপাশে পার্ক, খেলার মাঠ, পার্কিং ব্যবস্থা, সেপটিক ট্যাংকসহ সকল সুবিধা অবশ্যই থাকতে হবে।"