শীতকালেও আফগানিস্তানের আঙ্গুর টাটকা থাকে যে প্রাচীন কৌশলে
আকা সারায় গ্রামের ধূলিময় এক গলির শেষ প্রান্তে, মাটির দেয়াল ঘেরা ছোট্ট একতলা বাড়ির মেঝেতে বসে আছেন জিয়াউলহক আহমাদি। আঙ্গুর ক্ষেতসহ নানা ধরনের ফলের গাছ ঘেরা ও তুষার-ঢাকা পাহাড়ে বেষ্টিত গ্রামটি আফগানিস্তানের রাজধানী, কাবুল থেকে উত্তরে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ। ৪৫ বছর বয়সী আহমাদি খুবই যত্নসহকারে মুখবন্ধ একটি মাটির পাত্রের ওপর আঘাত করছিলেন; কিছুক্ষণের মধ্যেই পাত্রটি ভেঙে বেরিয়ে এলো এক মুঠো আঙ্গুর।
আহমাদি জানান, প্রায় পাঁচ মাস আগে ফসল তোলার সময় থেকে আঙ্গুরগুলো সেখানে ছিল; পারস্যের নববর্ষ 'নওরোজ' উপলক্ষ্যে মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল আঙ্গুরগুলো। এতগুলো মাস পরেও, আহমাদির আঙ্গুর তখনও টাটকা ও সতেজ দেখাচ্ছিল!
এক গাল হাসি দিয়ে তিনি বললেন, "আমরা একটি প্রাচীন সংরক্ষণ কৌশল ব্যবহার করে থাকি।"
আফগানিস্তানের উত্তরের গ্রামাঞ্চলে মাটির পাত্রে খাদ্য সংরক্ষণের এই কৌশল আফগানরা উদ্ভাবন করেছেন কয়েক শতাব্দী আগে। স্থানীয়ভাবে কৌশলটি 'কাঙ্গিনা' নামে পরিচিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাদের আমদানিকৃত দামি বিদেশি ফল কেনার সামর্থ্য নেই, শীতের মাসগুলোতে তারা এই কৌশলের কল্যাণে তাজা ফল উপভোগ করতে পারেন। রাজধানীর কাছাকাছি আরও বেশ কয়েকটি গ্রামে সঙ্গত কারণেই এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
আবারও গালভরতি হাসি দিয়ে আহমাদি জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার কাছে কি প্রায় অর্ধ বছর আঙ্গুর টাটকা রাখার অন্য কোনো পদ্ধতি আছে?"
আফগানিস্তানের সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যটন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মুর্তজা আজিজি জানান, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই পদ্ধতিতে ফল সংরক্ষণ করা হয়ে থাকলেও এ ব্যাপারে গবেষণা খুব কমই হয়েছে; তাই আনুষ্ঠানিক নথিপত্রও কম পাওয়া যায়। কিন্তু মাটির পাত্রের মুখ একেবারে বন্ধ করে দিয়ে, শীতের ঠান্ডা বাতাস ও আর্দ্রতা থেকে ফলকে সংরক্ষণ করার এই কৌশল খুবই কার্যকর। তবে, নির্দিষ্ট ধরনের আঙ্গুরের জন্য এই কৌশল সবচেয়ে উপযোগী।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আফগানিস্তান প্রতিনিধি রাজেন্দ্র আরিয়াল বলেন, "সাধারণত, কৃষকরা যারা 'কাঙ্গিনা' পদ্ধতিতে ফল সংরক্ষণ করেন, তারা তাইফি জাতের আঙ্গুর বেছে নেয়; কারণ এই জাতের আঙ্গুরের চামড়া মোটা এবং এটি মৌসুমের শেষের দিকে তোলা হয়।"
আঙ্গুরগুলোকে আবার মাটির পাত্রের ভিতরে রাখতে রাখতে আহমাদি জানান, "কৈশোরে আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ফল সংরক্ষণ করতে হয়; এবং আমি আমার নিজের সন্তানদেরও তা শিখিয়েছি।"
রাস্তার ধারে ছোট দোকানটিতে আঙ্গুর বিক্রি করেই আহমাদি সারাদিন কাটিয়ে দেন।
হিন্দুকুশ পর্বতমালার উর্বর মাটি ও শুষ্ক-উষ্ণ জলবায়ু, আফগানিস্তানে ফলচাষে এনে দিয়েছে বৈচিত্র্য। কৃষি, সেচ ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়য়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর কমপক্ষে দেড় মিলিয়ন টন ফল উৎপাদিত হলেও, এর মাত্র এক তৃতীয়াংশ রপ্তানি করা হয়। দেশটিতে প্রায় প্রতিবেলার খাবারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় তাজা ফল।
আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ডালিম ও তরমুজ উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে, দেশটির মধ্য অঞ্চল অর্থাৎ, আহমাদির গ্রাম আপেল, চেরি, এপ্রিকট ও আঙ্গুর বাগানের জন্য বিখ্যাত।
প্রতি মৌসুমে যখন ফল পাকতে শুরু করে, তখন আহমাদি ১ হাজার কেজি আঙ্গুর কিনে রাখেন। এর প্রায় অর্ধেক তিনি টাটকা অবস্থায় বিক্রি করেন; আর বাকি অর্ধেক তিনি কাঙ্গিনা পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে কয়েক মাস পর বেশি লাভে বিক্রি করেন।
আহমাদির ১১ বছর বয়সী মেয়ে সাবসিনার ভাষায়, "আমরা গ্রামের কাদামাটিই ব্যবহার করে থাকি; এর সঙ্গে খড় ও পানি মিশিয়ে বিশেষ ধরনের মাটির পাত্র তৈরি করি।"
স্কুলের পরে, ফসল তোলার সময় সাবসিনা তার বাবাকে কাজে সাহায্য করে।
মাটির বাসনগুলোকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা রোদে রাখার পর, সেগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। এরপর আঙ্গুরগুলোকে শুকনো সেই পাত্রে রেখে তার ওপর কাদা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়; পুরো শীতের মৌসুম মাটির পাত্রগুলোকে শুকনো ও ঠাণ্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সময় লাগে অন্তত ২০ দিন। গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারই এই পদ্ধতিতে ফল সংরক্ষণ করে থাকে।
এর পাশাপাশি যে আঙ্গুরগুলো সংরক্ষণ করা হয় না সেগুলো হয় খেয়ে ফেলা হয়, অথবা রোদে শুকিয়ে কিসমিস বানানো হয়।
আহমাদি শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যান; ছোটবেলায় তার বাবা ক্ষেত থেকে টাটকা আঙ্গুর নিয়ে ফিরে আসার স্মৃতি রোমন্থন করেন তিনি। কিন্তু আফগানিস্তানের যুদ্ধবিগ্রহের চিরায়ত রীতিতে পারিবারিক জীবন কতটা কঠিন হয়ে উঠেছে সেই আক্ষেপও তিনি শুনিয়েছেন।
১৯৯০'এর দশকের গৃহযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব নানগারহার প্রদেশে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা মাইনের ওপর পা রাখেন আহমাদি। বিস্ফোরণে তিনি বাম পা হারান; পাশাপাশি তার হাতও মারাত্মকভাবে জখম হয়। মাত্র দু'বছর আগে তিনি একটি কৃত্রিম পা পেয়েছিলেন; তবে, ততদিনে তিনি তার পুরানো ক্রাচে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, সেই কৃত্রিম পা আর ব্যবহার করেননি।
আহমাদি বলেন, "তাই আমার পুরো পরিবার ফসল তোলা ও আঙ্গুরের কাজে আমাকে সাহায্য করে।"
যদিও তার পরিবারের নিজস্ব কোনো ক্ষেত নেই, তার স্ত্রী ও বড় সন্তানেরা আশেপাশের কৃষকদের আঙ্গুর তোলার সময় সাহায্য করেন। সেই আঙ্গুর বেশ সস্তায় কিনে রাখেন আহমাদি।
আহমাদি বলেন, "সবচেয়ে কঠিন দিনগুলো ছিল তালেবানের শাসনের সময়। আমাদের গ্রাম তখন মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল; আমারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলাম।" পাকিস্তানে তিনি কলা বিক্রির পাশাপাশি ইট ভাটার শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন তখন।
২০০১ সালে আমেরিকান-নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের পর পরিবারটি আফগানিস্তানে ফিরে এসে আবারও বসবাস শুরু করে; কিন্তু যুদ্ধ কখনই থামেনি।
"আমরা ফিরে এসে দেখালাম, আমাদের ঘরবাড়ি, ক্ষেত-খামার সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা গ্রামকে আবারও গোড়া থেকে শুরু করতে হয়েছিল," আহমাদি বলেন।
তবুও, তিনি আশা করে তার সন্তানরা একদিন তার কাঙ্গিনা ব্যবসার দায়িত্ব নেবে, এবং প্রতি বছর বিশাল আয়োজনে নওরোজ উদযাপন করবে।
নওরোজে সাধারণত পারিবারের সবাই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া ও উপহার বিনিময় করেন। পিকনিকের জন্য পাহাড়ে যাওয়া, কবিতা আবৃত্তি ও আঙ্গুরসহ সাত ধরনের শুকনো ফল থেকে তৈরি 'হাফ্ট মেওয়া' খাওয়ার মাধ্যমেও এটি উদযাপন করা হয়।
নওরোজের জন্য তার মনে কোনো বিশেষ ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাইলে আহমাদি বলেন, "প্রচুর ফসল ফলুক; এবং আমার দেশে শান্তি নেমে আসুক।"
সূত্র: এটলাস অবস্কিউরা