আফগানিস্তান নিয়ে আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের আশা নিরাশার খেলা
অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য অথবা ভিনদেশি স্বার্থের যাঁতাকলে পিষ্ট, সমস্যাসঙ্কুল আফগান মরুর বুকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিংবা যুদ্ধাবস্থা গত কয়েক দশক ধরে প্রতিদিনের স্বাভাবিক চিত্র। সেখানকার এমন নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতি মেরামতে বিশ্ব-মোড়লদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার নজিরও ঢের আছে। বাস্তবিক অর্থে সেগুলো আবার কতটুকু সমস্যা সমাধানের তরে আর তার কত ভাগ জুড়ে ভূরাজনীতির খেলা সেটাই চিন্তার বিষয়!
আফগানিস্তান এমন এক ভূখণ্ড যেখানে কবি আবুল হাসানের 'রাজা যায় রাজা আসে'র মতো ক্ষমতা আর ক্ষমতার পিঠ চেপে বসা লোকেরা নিয়তই আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। এই আসা-যাওয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাস ঠেলে কাবুলের কর্তৃত্ব আবার তালেবানের হাতে উঠেছে সত্য, তবে তাদের এই উত্থান অতীতের মতো এক নিমিষেই পতনের দিকে মোড় নেয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
তালেবান নিয়ে অধিকাংশ মহলে যে উদ্বেগ বিরাজমান তা হলো তাদের কট্টরপন্থা, বিশেষত সমাজ, রাজনীতি আর ধর্মের মামলায় নিজেদের বাছ-বিচার। এসব কারণে দেশে-বিদেশে তারা যথেষ্ট প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেটা আবার তাদের টিকে থাকার পথে অন্তরায় বটে। তবে এইসব আদর্শিক ঘাত-প্রতিঘাত, বিদ্রোহ দমন, জাতীয় ঐক্য তথা অর্থনৈতিক মন্দাভাব থেকেও তালেবানদের জন্য এই মুহূর্তে বড় সংকট হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের আস্থা অর্জন তো কোথাও কোথাও তা টিকিয়ে রাখা।
এই অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে চীন-পাকিস্তান বলয়ের যে টানাপড়েন, আফগানিস্তানের সংকট তার বাইরের কিছু নয় এবং এর সমাধানের পথও এই মোড়লদের হাতে। আফগানিস্তান নিয়ে এর প্রতিবেশীসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের রয়েছে আলাদা আলাদা স্বার্থ, কোনো পক্ষই চাইছে না ভূরাজনীতির দাবার চাল তার বিপক্ষে যাক, সে কারণেই চারিদিকে আলোচনার এত ঘনঘটা! সেই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার পর এবার মাসের (নভেম্বর) প্রথম ভাগেই পাল্টাপাল্টি বৈঠক আয়োজন করে ভারত-পাকিস্তান, বিষয় আফগানিস্তান সংকট হলেও উভয়ের উদ্দেশ্য বলছে ভিন্ন কথা।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের 'দিল্লি রিজিওনাল সিকিউরিটি ডায়লগ'-এ ভারত ছাড়াও অংশ নিয়েছে রাশিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের প্রতিনিধিরা। যেখানে অনুপস্থিত ছিল বর্তমান আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখা দুই দেশ পাকিস্তান ও চীন, ছিল না কাবুল বা ওয়াশিংটনের কোনো প্রতিনিধিও। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করাটা অনুমেয়ই ছিল, তারা বরং আফগানিস্তানের উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্য ভারতকেই দুষছে, অপরদিকে চীন দেখিয়েছে ব্যস্ত সূচির অজুহাত। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে ফিরে তাদের আফগান বিষয়ক দূত টমাস ওয়েস্ট বৈঠক করেছেন দিল্লিতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সাথে।
সব পক্ষের উপস্থিতি না থাকলেও বাস্তবতা বলছে দিল্লি ডায়লগের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য কোনো অংশেই কম নয়। দিল্লিও চাইছে আফগানিস্তানে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে রাস্তা-ঘাট, বাঁধ থেকে শুরু করে সংসদ ভবন পর্যন্ত নির্মাণ করে যে প্রভাব আশরাফ ঘানির আমলে সৃষ্টি করেছিল তা আবার ফিরে পেতে।
প্রতিবেশী না হলেও অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারতের কাছে আফগানিস্তানের মূল্য সীমাহীন। পাকিস্তানকে চাপে রাখতে আফগান ভূখণ্ড ভারতের জন্য এতদিন ছিল সেফ জোন। আবার মধ্য এশিয়ায় নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানে রাখতেও কাবুলের গুরুত্ব ছোট করে দেখা যায় না। সেই দিক থেকে দেখলে তালেবানের ক্ষমতায় আসা ভারতের জন্য একধরনের দুঃসংবাদ বটে। আফগানিস্তানে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে কাশ্মীরের পরিস্থিতি যে আরো অশান্ত হবে সেটাও চিন্তাজনক তাদের জন্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন দিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের হাবভাব টের পাওয়ার পরেও কাবুলে তাদের পলিসি শিফট করেনি বলেই এই দশা। তবে ভারত যে আবার ক্ষমতা-কাঠামোয় ভারসাম্য আনতে চাচ্ছে সেটা তালেবানের সঙ্গে তাদের কূটনীতিকদের 'ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোম্যাসির' খবরে আন্দাজ করা যাচ্ছে। বিপরীতে তালেবান এতদিন ভারতকে শত্রু জ্ঞান করে এলেও কাবুল দখলের পর থেকে তারা হিসাবে পা ফেলছে।
আফগানিস্তান এখন যে আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে উঠে আসতে ভারত ও তার মিত্রদের সাহায্য তাদের অনেকখানি কাজে দেবে, সেটা তালেবান ভাল করেই জানে। দিল্লি ডায়লগেও ভারতসহ অন্যান্যরা আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা থেকে খাদ্য সহায়তার মত বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।
দিল্লির বৈঠক চীন, পাকিস্তান এড়িয়ে গেলেও যারা ছিল তারা কোন অংশে কম নয়। মস্কো-তেহরানের যেমন কাবুলে স্বার্থ আছে, তেমন আছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোরও। এদের মধ্যে আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত আছে ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের। আফগানিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি পশতুনদের বাইরে তাজিক আছে ২৭ শতাংশ, উজবেক ৯ শতাংশ, তুর্কমেন ৩ শতাংশ। মাদক তৎপরতার পাশাপাশি এদের নিয়েও চিন্তায় আছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো। অন্যদিকে তেমন কিছু না ঘটলেও তালেবান শাসনে সবচেয়ে বেশি শঙ্কায় আছে শিয়া সংখ্যালঘু হাজারা জাতি। ইরানও উদ্বিগ্ন সে কারণে। প্রতিকূল মুহূর্তে থাকার পরেও নিশ্চিতভাবে একসময়ের নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের বিদেশি মিত্ররা তাই সহজেই কাবুলে তালেবানকে মেনে নিচ্ছে না।
উল্টোদিকে দিল্লির বৈঠকের ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই পাকিস্তান, আগেরদিন ব্যস্ত থাকা(!) চীনসহ রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আয়োজন করে ট্রোইকা প্লাস বৈঠক। সেখানে ছিল তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির উপস্থিতি। ভারতের ডাকে সাড়া না দিয়ে পাকিস্তান নিজেরা আলাদা বৈঠক ডেকে স্পষ্টতই বার্তা দিতে চাচ্ছে দিল্লিকে যে, তারাই এখন আফগানিস্তানে চালকের আসনে আছে এবং আফগান জনগণের ভাগ্য তাদের হাতেই। ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে চিন্তা করলে দিনশেষে সত্যিকার অর্থে আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এটা ভুল পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে আগামীর জন্য, কারণ সব পক্ষের ঐকমত্য ছাড়া সেখানে কিছুই সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের ডাকা বৈঠকে অংশ নিয়ে মস্কো ও ওয়াশিংটন স্ট্যাটাস-কো রক্ষা করলেও, চীন সরাসরি ভারতের সাথে যে তার তিক্ত সম্পর্ক সেই ধারাবাহিকতায় জানান দিতে চাচ্ছে তারা নতুন করে কাবুলে ভারতীয় বলয় গড়ে উঠুক চায় না।
আফগানিস্তানে তালেবান থাকলে চীন-পাকিস্তানের যেমন সুবিধা আছে, তেমন ঝুঁকিও অনেক। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটছে, তা ক্ষোভ উসকে দিতে পারে আফগানিস্তানে। এমনিতেও তালেবানের সঙ্গে সখ্যতা আছে জিনজিয়াং থেকে পালিয়ে আসা বিদ্রোহীদের। চীন চায় জিনজিয়াং প্রদেশে বিদ্রোহ দমিয়ে রাখতে, তালেবানের নিশ্চয়তার বিপরীতে তারা তাদের সর্বাত্মক আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সমস্যা আরো প্রকট। আফগানিস্তানে তালেবানকে ক্ষমতায় আনতে গিয়ে এখন নিজ দেশে তালেবানপন্থি উগ্র সংগঠন টিটিপির পচা শামুকে পা কাটার সম্ভাবনাও তাদের সামনে প্রবল।
আফগানিস্তানের বিরূপ আবহাওয়ায় বেশিদিন টিকতে না পারার যে প্রথা, সেখানে রাজ করতে হলে ক্ষমতাসীনদের যেমন রক্ষা করতে হবে ভিনদেশিদের মন, তেমন অভ্যন্তরে প্রয়োজন সব জাতির সমর্থন। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আফগানিস্তান নিয়ে আঞ্চলিক দেশগুলোর সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও একইসাথে এর সম্পদের প্রাচুর্য ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান একে দিয়েছে 'দিল্লি কা লাড্ডুর' তকমা, খেলেও পস্তাতে হবে না খেলেও পস্তাতে হবে। এখন এই পস্তানো প্রতিবেশীদের শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় সেটাই আগামী দিনগুলোতে এই অঞ্চলের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
- লেখক: শিক্ষার্থী; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়