ন্যূনতম বয়সের আগে মিলবে না চাকরি, সিদ্ধান্ত সরকারের
'এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)' স্কিমের সুবিধা পেতে সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কাজে যোগ দেওয়ার ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ইবিএ'র অধীনে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অস্ত্র ছাড়া সমস্ত রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাবে।
সোমবার শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদের (ট্রাইপার্টাইট কনসালটেটিভ কাউন্সিল-টিসিসি) বৈঠকে সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের মধ্যে আইএলও'র কর্মসংস্থানের জন্য ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন অনুমোদন নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতেই এখন সরকার এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। সেই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে আইএলও-এর ন্যূনতম বয়স কনভেনশন অনুমোদনের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছিল।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৫৮ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে, যার ৬৪ শতাংশই তৈরি পোশাক।
কনভেনশনটি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিতে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, নৌপরিবহন, স্বাস্থ্য, কৃষি, পাট ও বস্ত্র, প্রবাসী কল্যাণ, সমাজকল্যাণ, যোগাযোগ, বাণিজ্য, পরিবেশ ও আইসিটিসহ অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়েছে সরকার।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আন্তর্জাতিক সংস্থা) মোঃ হুমায়ুন কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই কনভেনশনের অনুসমর্থন বাংলাদেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেতে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আইএলও'র আটটি মৌলিক কনভেনশনের মধ্যে সাতটি অনুমোদন করেছে। ন্যূনতম বয়স কনভেনশন অনুমোদন করা বাংলাদেশের জন্য আরেকটি অর্জন হবে।"
"আমরা এটি (কনভেনশন অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত) সুপারিশের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাব এবং সবশেষে, এটি মন্ত্রিসভায় পাস হতে হবে। এর পরে আমরা আইএলও'র সঙ্গে বসবো", তিনি আরও যোগ করেন।
আইএলও তার সদস্য দেশগুলোর জন্য আটটি মৌলিক কনভেনশন নির্ধারণ করেছে। এই কনভেনশনগুলোর মধ্যে পাঁচটি ১৯৭২ সালেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার ও দুটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার অনুসমর্থন দিয়েছে।
আটটি মৌলিক কনভেনশনগুলোর মধ্যে রয়েছে- সংগঠনের স্বাধীনতা ও কনভেনশন গঠনের অধিকারের সুরক্ষা, সংগঠনের অধিকার ও সম্মিলিত দর কষাকষি সংক্রান্ত কনভেনশন, জোরপূর্বক শ্রম বিলোপ সংক্রান্ত কনভেনশন, ন্যূনতম বয়স কনভেনশন, শিশু শ্রমের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সংক্রান্ত কনভেনশন, সমান পারিশ্রমিক কনভেনশন এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত কনভেনশন।
আইএলও'র ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৭৩টি রাষ্ট্র কনভেনশনটি অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে ৫৪টি দেশ কর্মে যোগদানের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করেছে ১৪ বছর, ৭৬টি দেশ ১৫ বছর ও ৪৪টি দেশ নির্ধারণ করেছে ১৬ বছর।
১৯৭৩ সালে গৃহীত এই কনভেনশন অনুসারে, তরুণদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা নৈতিকতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে এমন যেকোনো ধরনের চাকরি বা কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরের কম হবে না।
কনভেনশনে আরও বলা হয়েছে, কাজে যোগ দেওয়ার ন্যূনতম বয়স, বাধ্যতামূলক স্কুলে পড়া শেষ করার বয়সের চেয়ে কম হতে পারবে না এবং যেকোনো ক্ষেত্রে এটি ১৫ বছরের কম হবে না।
তবে, যে দেশের অর্থনীতি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সুবিধা অপর্যাপ্তভাবে উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে, সে দেশগুলো সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তা ও কর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষে, প্রাথমিকভাবে ১৪ বছর বয়স নির্ধারণ করতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন সেলের অতিরিক্ত সচিব (মহাপরিচালক) মোঃ হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে আইএলও-তে কাগজপত্র পাঠানোর পর তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে জিএসপি প্লাস স্কিম সুবিধা পেতে আইএলও'র মানবাধিকার ও শ্রম মান সম্পর্কিত ১৫টি কনভেনশনসহ বাংলাদেশকে মোট ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন মেনে চলতে হবে। কারণ বিদ্যমান জিএসপি সুবিধাটি এলডিসি থেকে উত্তরণের তিন বছর পরেই শেষ হয়ে যাবে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত 'আইএলও কনভেনশন ১৩৮' অনুসমর্থনের জন্য বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম এবং ২০২১ সালের মধ্যে শিশুশ্রমের সবচেয়ে খারাপ ধরনগুলো নির্মূল করার এবং সেই অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম টিবিএসকে বলেন, সরকারের কাজে যোগ দেওয়া সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন অনুমোদনের সিদ্ধান্তটি ভাল; তবে এক্ষেত্রে শ্রমিকদের হয়রানি অবশ্যই দূর করতে হবে।
তিনি বলেন, "অপারেশনাল পর্যায়েও বিশাল অভাব রয়েছে এবং সরকারের উচিত সেদিকে মনোনিবেশ করা।"
তিনি আরও বলেন, আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী কর্মে যোগদানের ন্যূনতম বয়স বাস্তবায়ন আনুষ্ঠানিক খাতে সম্ভব হলেও, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে অনানুষ্ঠানিক খাতে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।
আরও ৬টি কাজকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' ঘোষণার প্রস্তাব
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয় সোমবার ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক কাউন্সিলের সভায় শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত ৩৮টি কাজের বিদ্যমান তালিকায় আরও ৬টি কাজকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
কাজ ৬টি হল- গৃহস্থলির কাজ, শুটকি মাছের খাতে কাজ, রাস্তার কাজ, পাথর সংগ্রহ ও ভাঙা (ইট উৎপাদন, পাথর সংগ্রহ, ইট ও পাথর বহন এবং ভাঙা), স্থানীয় টেইলারিং ও পোশাক খাতে শিশু শ্রমিক এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ।