মানসা মুসাই কি সর্বকালের সেরা ধনী?
ফোর্বস ২০১৯ সালে ঘোষণা করেছে, ১৩১ বিলিয়ন নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী জেফ বেজোস। তিনি আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা। সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে এতো বেশি টাকার ভান্ডার গড়ে তুলতে আর কাউকে দেখা যায়নি। আর তখনই কি না বিবিসি নজর ফেরালো মধ্যযুগে। খুঁজে বের করল মানসা মুসাকে। যিনি আফ্রিকায় এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন। আটলান্টিকের পশ্চিম উপকূল থেকে মরুর দেশ নাইজার পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তাঁর এলাকায় অনেক স্বর্ণের বিশাল বিশাল ভান্ডার ছিল বলেই ভাবছেন ঐতিহাসিকরা আর তা দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন কমপক্ষে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। কেউ বলে এ সংখ্যাটি ৭০০ বিলিয়নও অতিক্রম করতে পারে।
ঘটনাটা ১৩২৪ সালের
মুসা নজর কাড়েন ১৩২৪ সালে। তিনি রওনা হয়েছিলেন মক্কায় হজ করতে। ষাট হাজারের বিশাল এক বাহিনী ছিল সঙ্গে। আর দাস ছিল ১২ হাজার। দলে বুদ্ধিজীবী, ধর্মতাত্ত্বিক, পারিষদরা ছিল। চলার পথে পড়েছিল কায়রো আর কায়রোতে তাঁর বাহিনীর সকলে এমনকি দাসেরাও স্বর্ণ ছড়িয়ে দিয়েছিল মুড়ি-মুড়কির মতো। বলা হয়ে থাকে কায়রোর অর্থনীতি পরের দশ বছর ধরে এর সুফল পেয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক রুডলফ বাচ ওয়্যার বিবিসিকে বলেছেন, সাম্প্রতিককালের গবেষকরা মুসার এতো এতো সম্পদের খোঁজ পাচ্ছেন যে তাঁদের দমবন্ধ হয়ে আসছে। তিনি অত্যধিক ক্ষমতাবানও ছিলেন।
মানিডটকমে জ্যাকব ডেভিডসন লিখছেন, সম্পদের হিসাবে মুসার ধারে কাছেও কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না আমরা।
২০১২ সালে ইউএস ওয়েবসাইট সেলিব্রিটি নেট ওয়ার্থ হিসাব করে দেখেছে যে মুসার মোট সম্পদের পরিমাণ ৪০০ বিলিয়ন ডলার ছিল। মানিডটকম সর্বকালের সেরা ধনীদের যে তালিকা প্রকাশ করে তা এমন :
১. মানসা মুসা (১২৮০-১৩৩৭, মালি সাম্রাজ্যের রাজা), সম্পদের পরিমাণ বর্ণনাতীত বাইরে
২. অগাস্টাস সিজার (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ - ১৪ খ্রিস্টাব্দ, রোমান সম্রাট), ৪.৬ ট্রিলিয়ন ডলার
৩. ঝাউ জু (১০৪৮-১০৮৫, চীনের সুঙ সাম্রাজ্যের সম্রাট), সম্পদের পরিমাণ গণনার বাইরে
৪. আকবর (১৫৪২-১৬০৫, ভারতের মুঘল সম্রাট), সম্পদের পরিমাণ গণনার বাইরে
৫. অ্যান্ড্রু কার্নেগী (১৮৩৫-১৯১৯, স্কটিশ আমেরিকান শিল্পপতি), সম্পদের পরিমাণ ৩৭২ বিলিয়ন
৬. জন ডি রকফেলার (১৮৩৯-১৯৩৭, আমেরিকার ব্যবসায়ী), সম্পদের পরিমাণ ৩৪১ বিলিয়ন ডলার
৭. নিকোলাই আলেক্সান্দ্রোভিচ রোমানভ (১৮৬৮ -১৯১৮, রুশ জার), সম্পদের পরিমাণ ৩০০ বিলিয়ন ডলার
৮. মির ওসমান আলী খান (১৮৮৬ -১৯৬৭, ভারতীয় জমিদার), সম্পদের পরিমাণ ২৩০ বিলিয়ন ডলার
৯. উইলিয়াম দ্য কনকয়্যারার (১০২৮-১০৮৭, ব্রিটিশ রাজ) সম্পদের পরিমাণ ২২৯.৫ বিলিয়ন ডলার
১০. মুয়াম্মার গাদ্দাফী (১৯৪২-২০১১, লিবিয়ার শাসক), সম্পদের পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলার
মানসা মুসার বংশ পরিচয়
মুসার ভাই মানসা আবু বকর ১৩১২ সাল পর্যন্ত মালি সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। ১৪ শতকের সিরীয় ঐতিহাসিক শিবাব আল-উমারি জানাচ্ছে, আবু বকর অতলান্তিক সাগরের ওপারে কী আছে, তা জানতে আগ্রহী ছিলেন। ২০০০ জাহাজের একটি বহর নিয়ে তিনি আটলান্টিক অভিযানে বের হন এবং আর কখনোই ফেরেননি।
আমেরিকার ঐতিহাসিক আইভান ভান সার্টিমাও ওই ভাবনায় হাওয়া দেন যে, আবু বকর দক্ষিণ আমেরিকায় পৌছেছিলেন। অবশ্য এর কোনো দলিল নেই। মানসা মুসা তাঁর ভাইয়ের গদীতে আসীন হন। তাঁর শাসনে মালি সাম্রাজ্য আয়তনে, অর্থনীতিতে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানেও বিস্তৃত হয়। টিমবাকটুসহ ২৪টি শহর ছিল তাঁর সাম্রাজ্যে। আজকের সেনেগাল, মোরিতানিয়া, মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, গাম্বিয়া, গিনি-বিসাউ, গিনি ও আইভরি কোস্টের একটি বিশাল অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁর সাম্রাজ্য। সেকালে চীন ছাড়া এতোবড় সাম্রাজ্য আর ছিল না। উল্লেখ্য টিম্বাটুতে তিনি ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদির চর্চা হতো। উল্লেখ্য মুসা মক্কা থেকে বেশ কয়েকজন ইসলামিক পণ্ডিত নিয়ে এসেছিলেন যাদের মধ্যে নবী (সঃ) এর একজন উত্তরপুরুষও ছিলেন। এছাড়া তিনি আন্দালুসিয়ান কবি ও স্থপতি আবু এস হাককেও নিয়ে এসেছিলেন। তিনি জিংগুয়েরবার মসজিদের স্থপতি হিসাবে সমধিক খ্যাত। মুসা কবিকে ২০০ কেজি স্বর্ণ প্রদান করেছিলেন। আজকের হিসাবে এটি ছিল ৮.২ মিলিয়ন ডলারের সমান। শিল্প-সংস্কৃতি ও স্থাপত্যচর্চাকে উৎসাহ দিতে তিনি গ্রন্থাগার আর মসজিদও গড়ে তুলেছিলেন অনেক। টিম্বাকটু তাই সেসময়ে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
মালি সাম্রাজ্য (৮০০ থেকে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ)
মালি সাম্রাজ্যে স্বর্ণ আর লবণের বড় মওজুদ ছিলণ। ব্রিটিশ মিউজিয়াম জানাচ্ছে, মুসার আমলে মালিতে সারা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক স্বর্ণের ভাণ্ডার ছিল। 'আর এর পুরোটা ছিল রাজার অধীনে, এতে তাঁর অধিকারও ছিল অবারিত'। বলছিলেন, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাথলিন বিকফোর্ড ।
মিশর অতিক্রমকালে
মুসা মিসর অতিক্রম করেছিলেন ১৩২৩ সালে। তারও বারো বছর পর আল-উমারি গিয়েছিলেন কায়রো। মিসরের লোক তখনো মুসার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। তিনি তিনমাস ছিলেন কায়রোয়, আর এতো স্বর্ণ বিলিয়েছেন যেমন ১০ বছর ধরে মিসরের অর্থনীতি তাতে চাঙা ছিল। তবে এতে মালির লোকগায়করা অসন্তুষ্ট হয়েছিল কারণ তাঁরা ভাবছিল, মুসা মালির সম্পদ বিলিয়ে দিল ভিনদেশে। তাই তাঁদের গানে ওই ঘটনার প্রশস্তি শোনা যায় না।
মানচিত্রে মুসা
অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদিতে মুসা মালিকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে ১৩৭৫ এর কাতালান অ্যাটলাস ম্যাপে দেখা গেল এক আফ্রিকান রাজাকে যিনি সোনার সিংহাসনে বসে আছেন হাতে স্বর্ণ নিয়ে। টিম্বাটুকটু তাই আফ্রিকার এল ডোরাডো হয়ে উঠল এবং দূর দূর থেকে লোক হাজির হলো টিম্বাকটুতে।
উনিশ শতকেও কিন্তু টিম্বাকটু তার সোনালী অতীতের গল্প ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আর তাতে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপের ভাগ্যান্বেষী ও অভিযাত্রীরা এসে হাজির হচ্ছিল টিম্বাটুতে।
মুসা মৃত্যুবরণ করেন ৫৭ বছর বয়সে ১৩৩৭ সালে। তাঁর সন্তানরা পরে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছে। তবে এতো বড় সাম্রাজ্য তাঁরা ধওে রাখতে পারেনি। ইউরোপীয়দের আগমন তাঁর সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।
- সূত্র: বিবিসি