আফ্রিকায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ নিয়ে ফের আলোচনা শুরু
আফ্রিকার দেশগুলোতে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করার ব্যাপারে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে শুধু টাস্কফোর্স গঠন ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেছে বাংলাদেশ। সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না নিয়ে কখনও এক পা এগিয়েছে তো পরক্ষণেই দু-পা পিছিয়েছে।
অবশেষে এই উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দিতে এবং আফ্রিকার অন্তত দুটি দেশের সঙ্গে জমি ইজারা চুক্তি করার জন্য নতুন উদ্যোগের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ওই অঞ্চলে কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ে ভারত, পাকিস্তানের সফলতা ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে এবার কোমর বেঁধে আফ্রিকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পররাষ্ট্র, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। আফ্রিকার যেসব দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন আছে, প্রাথমিকভাবে এমন দুটি দেশকে বাছাই করেছে কৃষি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, লেবানন, দক্ষিণ সুদান, সুদান (দারফুর), পশ্চিম সাহারা, মালি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রসহ আটটি দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন আছে।
চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ শুরুর মাধ্যমে শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই আসবে না, আফ্রিকায় বাংলাদেশের ৪০-৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বলেও আশা করছে সরকার।
জমি ইজারা নিয়ে চুক্তিভিত্তিক কৃষিকাজ করার জন্য ২০১৩ সালে দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে চুক্তির খসড়া তৈরি করেছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। ওই খসড়া সংগ্রহ করে গত ২৮ নভেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে মতামত চেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সালের তথ্য অনুসারে, দক্ষিণ সুদানের কৃষি জমির মাত্র ৮ দশমিক ৮ শতাংশ ফসলি জমি হিসেবে, অর্থাৎ ফসল চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৯১ দশমিক ৯ শতাংশ জমিই চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে খসড়াটি তৈরি করলেও, এরপর আর তেমন অগ্রগতি হয়নি।
খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ২৫ বছর মেয়াদে জমি ইজারা নেওয়ার হবে, তারপর ৫ বছর করে মেয়াদ নবায়ন করা হবে।
আর আগে গত ২৩ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের যৌথ সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, আফ্রিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশের সমরূপ আবহাওয়া বিদ্যমান এবং সেখানে খাদ্যশস্য, শাক-সবজি ও ফলমূল সারা বছরই উৎপাদন করা যায়। আফ্রিকার দেশগুলোতে ভুট্টা, পাট, পেঁয়াজ, আম, কাজুবাদাম, কুমড়া ও চীনাবাদাম উৎপাদন এবং গরু পালনের সম্ভাবনার রয়েছে।
ওই সভায় আফ্রিকায় জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের জন্য বিভিন্ন দেশে জমি বরাদ্দ নেওয়ার ব্যাপারে আফ্রিকার দেশগুলোতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের জন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাঠানো সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে বলে ওই সভায় জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, আফ্রিকার দেশগুলোতে জমি ইজারা নিয়ে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কৃষি, পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আফ্রিকায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো যৌথভাবে কাজ করছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ও ইনস্টিটিউটগুলো আফ্রিকার কৃষি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে।
মধ্য-জানুয়ারির মধ্যেই স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ মডিউল প্রস্তুত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের জন্য একটি খসড়া চুক্তি প্রণয়নের কাজও শুরু করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
হেলায় ফেলে রাখা সুযোগ
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে আফ্রিকার দেশগুলো বাংলাদেশকে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের প্রস্তাব দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আফ্রিকায় জমি ইজারা নেওয়ার সুযোগ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করলেও কোনো সাড়া পায়নি।
অথচ এই সময়ে চীন, মিশর, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ আফ্রিকায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করে সফলতা পেয়েছে।
আফ্রিকায় চাষাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে আফ্রিকায় জমি লিজ নিয়ে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ শুরু করার জন্য মূলধন স্থানান্তরের আবেদন করেছিল নিটল-নিলয় গ্রুপ। কয়েক বছর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘুরেও অনুমতি না পেয়ে চেষ্টায় ক্ষান্ত দেওয়ার কথা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান গ্রুপটির চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ।
তিনি বলেন, 'তখনও আফ্রিকায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিং শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী দু-তিনটি সভা করেছিলেন, বিনিয়োগ করার জন্য আমাদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। তার প্রেক্ষিতেই আবেদন করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আইন পরির্বতন করে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট খোলার পারমিশন না দেওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।'
'আফ্রিকায় কৃষিখাতে বিনিয়োগের জন্য অল্প টাকার দরকার হয়। ওই পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে যেভাবে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়, তাতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে,' যোগ করেন তিনি।
ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হলে কেবল আফ্রিকায়ই নয়, বাংলাদেশ থেকে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রেও জমি ইজারা নিয়ে কৃষিখামার স্থাপন করতে আগ্রহী হবে বলেও মত দেন তিনি।