পার্ক ইজারা দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সংরক্ষিত করলো দক্ষিণ সিটি
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের একমাত্র স্বস্তির জায়গা শহীদ মতিউর পার্কটি ইজারা দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সংরক্ষিত করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। উন্মুক্ত পার্কটির চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ভিতরে বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি রাইড ও খাবারের দোকান। এমনকি এর এক পাশে বসানো হয়েছে মৌসুমি ফলের আড়ৎ।
পার্কটি ইজারা দিয়ে টিকেট সিস্টেম করে জনসাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। দক্ষিণ সিটি বলছে পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং রাইডগুলোর তত্ত্বাবধানের জন্য এটিকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। সেই খরচের জন্য ১০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এধরনের একটি পাবলিক পার্ককে সিটি কর্পোরেশন ইজারা দিয়ে প্রবেশ সংরক্ষিত করতে পারে না। এমনকি শিশুদের খেলার জন্য হালকা রাইড বসাতে পারে তবে সিটি কর্পোরেশন নৈতিকভাবে এমন ভারি রাইড পার্কে বসাতে পারে না।
প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে 'জল-সবুজে ঢাকা' প্রকল্পের মাধ্যমে গুলিস্তান শহীদ মতিউর পার্কটির আধুনিকায়ন করে ২০২০ সালে পার্কের চারদিকের দেয়াল সরিয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় দক্ষিণ সিটি। পার্কটির নকশা অনুযায়ী, এর চারপাশ থাকবে উন্মুক্ত যাতে যেকোনও দিক দিয়ে পার্কে প্রবেশ করা যায়। এ পার্কটির নকশা করেছিল স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান সাতত্য। সাতত্যের প্রধান স্থপতি রফিক আজম তখন বলেছিলেন, 'যখনই কোনো উদ্যান বা পার্ক দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা হয় তখন ভেতরে অপরাধ দানা বাঁধে। উন্মুক্ত থাকলে সবকিছু নজরদারিতে থাকে। এজন্য পার্কটির চারদিক উন্মুক্ত রেখে এর সংস্কার করা হয়েছে।'
তবে গত নভেম্বরে দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ এক বছরের জন্য প্রায় ২০ লাখ টাকায় পার্কটি ইজারা দেয় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. অলি উল্লাহ ও রনি শিকদারের কাছে। ইজারা নেওয়া পার্কটির চারিদিক দেয়াল দিয়ে ঘিরে জনসাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত রেখে টিকেট সিস্টেম করা হয়েছে।
পার্কটি ইজারা দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না উল্লেখ করে স্থপতি রফিক আজম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের ডিজাইনের মধ্যে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আর এভাবে যে দেয়াল তোলা হয়েছে সেটাও আমাকে জানানো হয়নি। এভাবে একটি পাবলিক প্লেস ব্যবসায়িকভাবে পরিচালনা হতে পারে না। এটা আমাদের জন্য লজ্জারও। সিটি কর্পোরেশন আমাদের সাথে কোনো আলোচনা না করেই ইজারা দিয়েছে।'
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'এভাবে পার্কগুলো সীমানাপ্রাচীরে ঘিরে দিলে শিশুরা কোথায় খেলবে? মানুষের হাঁটার জায়গা এমনিতেই কমছে এরপর যেটুকু আছে তাও সংরক্ষিত করে ফেললে মানুষ নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা কোথায় পাবে?'
সম্প্রতি পার্কটি ঘুরে দেখা যায়, পার্কটির চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে ৩টি প্রবেশমুখ রাখা হয়েছে। প্রতিটি প্রবেশমুখেই আছেন ইজারাদারদের লোকজন যারা ১০ টিকেটের বিনিময়ে পার্কে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। প্রায় ৩.৫ একর জমির উপর গড়ে ওঠা পার্কটিতে রয়েছে আম, জাম, ঝাউ, মেহগনি, পাতাবাহার, আকাশি, ইউক্যালিপটাসসহ কয়েক প্রজাতির ফুল গাছ। দর্শনার্থীদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুটি নাগলিঙ্গম গাছ। তবে এর পূর্ব পাশে বসানো হয়েছে নাগরদোলা, ট্রেনসহ অন্তত ৮টি রাইড। যে রাইডগুলোর প্রতিটিতে চড়তে খরচ পড়বে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। চটপটি, ফুসকা, ফাস্টফুডসহ বাসনো হয়েছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান।
পার্কের মধ্যে চারদিকের পাড় বাঁধাই করা একটি পুকুরও রয়েছে তবে এ পুকুরেও আছে ওয়াটার বোটের রাইড, যেখানে নেওয়া হয় জনপ্রতি ৫০ টাকা।
পার্কে আসা লোকজনের মতে, এ ধরনের একটি উন্মুক্ত পার্ককে এভাবে বাণিজ্যিক স্পটে রূপান্তর করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এমনকি রাইডগুলোতেও অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান অনেকেই।
পার্কটি সংস্কারের পরে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরেও সিটি কর্পোরেশনের তেমন কোনো তত্ত্বাবধান ছিল না। মাদকাসক্তদের আসরসহ অসামাজিক কার্যকলাপ ঠেকাতে দেওয়া হয়েছিল আনসার বাহিনী। তখনও এখানে থাকতো শত শত ভাসমান ও মানসিক ভারসাম্যহীন লোকজন। এরপরেও নিয়মিত অনেকেই এ পার্কে শরীর চর্চাসহ শিশুরা খেলাধুলা করতো।
পার্কটি ইজারা দেওয়ার আগে নিয়মিতই সকালে হাঁটতে আসতেন আবু হানিফ। এখন পার্কটির পরিবেশ ঠিক হলেও সকালে আর হাঁটতে পারছেন না তিনি।
আবু হানিফ টিবিএসকে বলেন, 'এ পার্কে এখন ১০ টাকার টিকেট কেটে হাঁটতে হয়। এভাবে একটি পাবলিক পার্কে বাণিজ্যিক রাইড বসালে নগরবাসী নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা কোথায় পাবে? এভাবেই নগরের সবুজ স্থান হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই শহরে সবার জন্য উন্মুক্ত জায়গাও থাকুক আবার রাইডসহ শিশুপার্কও গড়ে উঠুক।'
যাত্রাবাড়ি থেকে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে আসা নুরুন্নাহার বেগম টিবিএসকে বলেন, 'আগে তো এখানে টাকা ছাড়াই প্রবেশ করে বাচ্চাদের কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে নিয়ে যেতাম কিন্তু এখন ১০ টাকার টিকেট কেটে প্রবেশ করে ছোট ছোট রাইডগুলোতেও ৩০/৫০ টাকা দিয়ে বাচ্চাদের চড়াতে হচ্ছে। এখানকার ব্যবস্থাপনা তেমন ভালো না।'
এদিকে পার্কের পশ্চিম দিকের 'মহানগর নাট্যমঞ্চ'র পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে মৌসুমি ফলের আড়ৎ। ইজারাদাররা তাদের লোকসান পোষাতে সাময়িক এই ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানান তারা। তবে এজন্য সিটি কর্পোরেশন দেয়নি কোনো অনুমতি। আড়তে রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্তই চলে মৌসুমি ফল লিচুর কেনাবেচা।
দর্শনার্থীরা বলছেন, পার্কের মধ্যে লিচুর আড়ৎ বসিয়ে এর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে পুরো পার্কটি একসময় ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিণত হবে।
ফল ব্যবসায়ীরা জানান, রাত ৯টার পর থেকে জমতে থাকে ফলের বাজার। বেচাকেনা চলে পরদিন সকাল পর্যন্ত। তারা ইজারাদারদের টাকা দিয়েই এ স্থান ব্যবহার করছেন বলেন জানান।
ইজারাদার রনি শিকদার টিবিএসকে বলেন, 'একসময় এই পার্কে সাধারণ মানুষ আসতে চাইত না। মাদকসেবনসহ নানা অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলত। এখন সাধারণ মানুষ বিনোদনের জন্য আসে। মেইনটেন্যান্স খরচের জন্য ১০ টাকা টিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।'
পার্কের মধ্যে ফলের আড়তের বিষয়ে তিনি বলেন, 'পার্কে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তাতে পোষাচ্ছে না। প্রচারণা না থাকায় বেশি মানুষ আসছে না। তাই প্রচারের জন্য একটি মৌসুমি ফলের মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এ জন্য সিটি করপোরেশনে আবেদন করা হয়েছে।'
তবে দক্ষিণ সিটি বলছে তারা এমন কোনো আবেদন পায়নি। আর আবেদন করলেও এমন কোনো ফলের আড়ৎ দেওয়ার সুযোগ নেই এবং যদি দিয়েও থাকে তবে তা উচ্ছেদ করা হবে বলে টিবিএসকে জানান দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ রাসেল সাবরিন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, 'পার্কটিতে আমরা বেশ কয়েকটি রাইড বসিয়েছি যেগুলো দেখাশোনার জনবল সিটি কর্পোরেশনের নেই, তাই ইজারা দিয়েছি। তারা ১০ টাকার টিকেটের বিনিময়ে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকে কেউ রাইডে না চড়তে চাইলে খেলাধুলা করারও পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।'
এভাবে একটি পাবলিক পার্ককের প্রবেশ সংরক্ষিত করতে পারে কিনা এবং এমন রাইডসহ দোকান বসাতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, 'পার্কটি তৈরী হয়েছে প্রকল্প অনুযায়ী আর এটি এখন ব্যবস্থাপনা হবে সিটি কর্পোরেশনের নেওয়া সিদ্ধান্তের উপর।'
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন নৈতিকভাবে এ ধরনের পাবলিক স্পেস কোনোভাবেই ইজারা দিয়ে তে মানুষের প্রবেশাধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। এটা একদমই অন্যায্য। পার্কে প্রবেশের জন্য ১ টাকার টিকেটও রাখা যাবে না উল্টো জনগণের সুবিধার কথা চিন্তু করে পার্কে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
সিটি কর্পোরেশন নিজেই জানে না পার্কে কী হচ্ছে, এটা সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতাও বটে উল্লেখ করে এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, 'সিটি কর্পোরেশনের অধীনে তো আর হাজার হাজার পার্ক নেই যে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে না। পার্কগুলো সংরক্ষণ এবং দেখভালের সক্ষমতা আছে সিটি কর্পোরেশনের। পার্ক ও খেলার মাঠগুলো সিটি কর্পোরেশনের নজরদারিতে থাকা উচিত এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ তাদেরই করতে হবে।'