যখন চিঠি যেত মিসাইলে চড়ে...
এই সেদিনই শচীনকর্তা গেয়েছিলেন, 'সুজন মাঝিরে ভাইরে কইও গিয়া, না আসিলে স্বপনেতে দেখা দিত বইলা'। অপেক্ষার সঙ্গে আরো একটি বিষয় এখানে ভাবার মতো। ভেঙে বলি- বোন বসে আছে নদীর তীরে, মাঝি যাচ্ছে নৌকা ঠেলে, বোন তাঁকে ডাকছে সুজন মানে ভালো মানুষ নামে আর বলছে যদি আসার সময় না পায় ভাই তবে যেন অন্তত স্বপনে দেখা দেয়। এখন প্রশ্ন ঘুরছে কয়েকটা মনে, বোন কি লিখতে জানে না নাকি তাঁর বাবার বাড়িতে ডাক পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না? তাহলে বোনের কষ্ট মিটল কীভাবে?
মিসাইল মেইল
পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি দূরকে এনেছে কাছে। ডাক ব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দিয়েছে দূর দূরে। তারপর এয়ারমেলও এসে গিয়েছিল। আর ঐতিহাসিক সিনেমাগুলোতে অনেকেই মিসাইল মেইল দেখে থাকবেন। তীরের মাথায় জুড়ে ধনুক দিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে রাজারা শত্রু শিবিরে পত্র পাঠাত। তাতে হুমকি ধমকি থাকত বেশি- আর বেশি এগিও না, রক্ষা পাবে না কিংবা আগামীকালের মধ্যে আত্মসমর্পণ করো নইলে পানির তেষ্টায় ছটফটিয়ে মরবে ইত্যাদি। তবে প্রেমের পত্রও পাঠিয়েছে রাজাদের ছেলে মেয়েরা তীরে চড়িয়ে। এরই আধুনিক সংস্করণ দেখা গেল ১৮১০ সালে। জার্মান কবি ও নাট্যকার হাইনরিখ ফন ক্লেইস্ট সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধ লিখলেন। তখন তো রকেটবিজ্ঞান মোটে শিশু। চোঙায় গানপাউডার ঠেসে পুরে পিছনে আগুন ধরিয়ে সৈনিকরা গোলা ছুড়তে জেনেছে কেবল। নিবন্ধে হাইনরিখ হিসাব করে দেখালেন, বার্লিন থেকে ১৮০ মাইল দূরের এক জায়গায় রকেটে করে চিঠি পাঠাতে লাগবে মাত্র আধা দিন আর একজন ঘোরসওয়ারের সময়ের দশ ভাগের এক ভাগ।
পলিনেশিয়ায় প্রথম
টোঙ্গার ছোট্ট দ্বীপ পলিনেশিয়া। হাইনরিখের বুদ্ধি পরখ করতে বেছে নেওয়া হলো পলিনেশিয়াকে। কিন্তু হাইনরিখ হালে পানি পেলেন না কারণ রকেটে চিঠি চড়িয়ে দেওয়ার পর তা জায়গায় চেয়ে বেজায়গায় পড়ল বেশি। তাই লোকে ভুলে গেল পত্রবাহী রকেটের কথা। শেষে আরো শত বছর পওে এক জার্মান প্রকৌশলী, নাম হারমান জুলিয়াস ওবের্থ যাকে রকেটবিজ্ঞানের একজন স্থপতিও ধরা হয় আবার হাইনরিখের নিবন্ধটি পড়তে থাকলেন। সেটা ১৯২৭ সাল। পরের বছরের জুন মাসে ওবের্থ ড্যানজিগে অনুষ্ঠিত সায়েন্টিফিক সোসাইটি অব অ্যারোনটিকসে একটি ভাষণ দিলেন। তাঁর কথাবার্তা উপস্থিত সুধী সমাজের পছন্দও হলো। তিনি বললেন, ছোট ছোট রকেট চিঠিপত্র ৬০০ থেকে ১২০০ মাইল দূরে পৌছাতে দিতে পারে। তবে তাতে পথনির্দেশক যন্ত্র লাগাতে হবে। জ্বালানির ব্যাপারটিও ভাবনায় রাখতে হবে। ওবের্থের বুদ্ধি ক্রমে ক্রমে গোটা দুনিয়াতেই ছড়িয়ে পড়ল। জার্মানির আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এমনকি লিখে নিলেন তাঁর তত্ত্ব।
শিমিড এলেন পর্দায়
ওবের্থের তত্ত্বটাকে প্রথম বাস্তবে রুপ দিলেন এক অস্ট্রিয় প্রকৌশলী। তাঁর নাম ফ্রিডরিখ শিমিড। তিনি থাকতেন অস্ট্রীয় আল্পসে। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে পাহাড়ি গ্রামগুলোয় চিঠি পৌছানো কতটা ঝক্কির। দুটি পাহাড়ি গ্রামের একটি থেকে আরেকটিতে হেঁটে যেতে আট ঘণ্টার কম লাগে না কিন্তু রকেটে করে চিঠি পৌছাতে দুই ঘণ্টাও লাগবে না। শিমিড আগে থেকেই সলিড ফুয়েল (কাঠকয়লা, শুকনো গোবর ইত্যাদি) নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন। ১৯২৮ সালে শিমিড স্ট্র্যাটোমন্ডলীয় (পৃথিবীর ১২ কিলোমিটার ওপর থেকে ৫৫ কিলোমিটার ওপর পর্যন্ত) বেলুন নিয়ে একটি পরীক্ষা চালান। তিনি শেষমেশ ১৯৩১ সালে সফল হন রকেট মেইল উৎক্ষেপণে। সেবার ১০২টি চিঠি পাঁচ কিলোমিটার দূরের এক জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল তাঁর রকেট। রকেটটি রিমোট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল আর তার অবতরণের জন্য একটি প্যারাসুট ব্যবহার করা হয়েছিল। শিমিডের পরের রকেটটি ৩৩৩টি মেইল পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, শিমিডের রকেট সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৪৬০ ফুট ওপর থেকে যাত্রা শুরু করে ৪৬০০ ফুট ওপর পর্যন্ত ওঠে তারপর অবতরণ করে। শিমিডের দেখাদেখি পৃথিবীর আরো কিছু দেশ যেমন ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া রকেট মেইলের প্রচলন ঘটায়। এমনকি ভারতও। পরে জেরহার্ড জুকার নামে এক ব্যবসায়ী প্রদর্শন করেন যে ৪৮০০ চিঠি নিয়ে সমুদ্রও পাড়ি দিতে সক্ষম রকেট। এটা ঘটেছিল স্কটল্যান্ডের দুটি দ্বীপের মধ্যে।
ভারতে রকেট
ভারতে ভালোই সফল হয়েছিল রকেট মেইল। স্টিফেন স্মিথ নামের এক নভো প্রকৌশলী ভারতে এটি চালু করেছিলেন। তিনি ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৪ এর মধ্যে ২৭০টি রকেট উৎক্ষেপন করেন। তিনি ইতিহাস তৈরি করেন একটি খাবার বাক্স পাঠিয়ে যাতে চাউল, মশলা আর সিগারেট ছিল। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত পাকিস্তানের কোয়েটায় তিনি ওই বাক্স পাঠিয়েছিলেন। রকেটটিকে তখন নদী পার হতে হয়েছিল। আরেকবার স্মিথ একটি মোরগ ও একটি মুরগী রকেটের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন। সেগুলো নিরাপদ অবতরণে সমর্থ হয়েছিল। পরে মোরগ-মুরগী দুটিকে কোলকাতা চিড়িয়াখানায় দান করা হয়েছিল। আরেকবার তিনি একটি সাপও প্রেরণ করেছিলেন। স্মিথকে সিকিমের মহারাজা সবরকম সহায়তা দিয়েছিলেন আর সিকিমেই তিনি রকেট ব্যবহার করেছিলেন বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে রকেট
১৯৫৯ সালের আগে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে রকেটের ব্যবহার সেরকম উল্লেখযোগ্য ছিল না। সেবার ডাক বিভাগ এখন ওয়ারহেড যে জায়গায় বসানো হয় সেখানে দুটি চিঠির বাক্স বসিয়ে মিসাইলে আগুন ধরিয়েছিল আর তা গিয়ে পৌঁছেছিল ফ্লোরিডার একটি নেভাল স্টেশনে। দূরত্ব ছিল ৭০০ মাইল। ৩০০০ চিঠি বহন করেছিল রকেটটি। একই চিঠির কপি ছিল সেগুলো। পোস্ট মাস্টার জেনারেল লিখেছিলেন সেটি। স্টেশনের সব ক্রু একটি করে কপি পেয়েছিল। প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারও পেয়েছিলেন একটি। এটি পাঠিয়ে পোস্ট মাস্টার বার্তা দিয়েছিলেন যে, ডাক বিভাগ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে তৈয়ার আছে। পরে পোস্টামাস্টার এটাও বলেছেন, রকেটে করে মানুষ চাঁদে যাওয়ার আগে অন্তত এটুকু আমরা পারব যে চিঠিপত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যেই নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, ব্রিটেন বা ভারত কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় পৌছাতে। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ ছিল না কারণ রকেট মেইলের খরচ ছিল অনেক বেশি। ফ্লোরিডার ওই রকেট মেইলে খরচ হয়েছিল দশ লক্ষ মার্কিন ডলার। অথচ ডাকটিকিট বিক্রি বাবদ আয় হয়েছিল মাত্র ২৪০ ডলার।