ছাত্রদের কাছে দুলাল কাকার স্যুপ কেন এত প্রিয়? দাম মাত্র ২০ টাকা, তাই?
"বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়" প্রবাদটির যথাযথ উদাহরণ দেখা যায় দুলাল স্যুপ কর্নারে গিয়ে। পুরান ঢাকার জয়নাগ রোডে দুলাল কাকার স্যুপের দোকানে নামের কোনো সাইনবোর্ড নেই। খাবারের জনপ্রিয়তার কারণে সবার মুখে মুখেই পরিচিত এই দোকান।
২৩ বছর আগে শুরু হওয়া ৩ টাকা বাটির স্যুপ এই দুর্মূল্যের বাজারে এখন পাওয়া যায় ২০ টাকায়। স্বাদে কোনো অংশে কম নয় নামি-দামি রেস্তোরাঁ থেকে।
"জয়নাগ রোডের মাথা থেকেই দুলালের স্যুপের দোকান কোনটা বলে জিজ্ঞেস করলে যে কেউ দেখিয়ে দিবে দোকান। মানুষ এমনিতেই আমাদের চিনে, তাই কখনো সাইনবোর্ড লাগানো হয়নি," বলেন দুলাল কাকার বড় ছেলে তুষার।
বকশীবাজারে শিক্ষা বোর্ডের পাশের জয়নাগ রোডের গলিতে মোঃ মনসুর আহমেদ দুলাল ওরফে দুলাল কাকার মুদির দোকান ছিল নব্বইয়ের দশকে। মুদির দোকানের পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবেই নিজের রেসিপিতে তৈরি স্যুপ বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন তিনি।
"সেই সময় এলাকায় স্যুপ খাওয়ার চল ছিল না বেশি। পারিবারিকভাবেই বানিয়ে শুরু করার পর দেখলাম সবাই অনেক পছন্দ করছে," বলেন দুলাল স্যুপ কর্নারের সত্ত্বাধীকারী দুলাল কাকা।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মুদির দোকানের পাট চুকিয়ে খাবারের আয়োজন নিয়েই স্থিতু হলেন দুলাল কাকা। স্যুপের পাশাপাশি বানালেন নুডুলস। পাশেই বুয়েট, ঢাকা, মেডিকেল কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল অবস্থিত হওয়ায় ছাত্রদের আনাগোনা শুরু থেকেই বেশি ছিল। ছাত্রদের মাধ্যমেই সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিলো আশেপাশের এলাকাতেও।
সেসময় ৫০০ টাকা পুঁজিতে শুরু করা এই ব্যবসায় এখন দিনে রোজ বিক্রি হয় ৫-৭ হাজার টাকার। বিশেষ আয়োজনে নানা জায়গায় রান্না করেও দিয়ে আসেন দুলাল কাকার ছেলেরা।
স্যুপের পাশাপাশি আরও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় দুলাল স্যুপ কর্নারে। সবগুলো আইটেমের দামই আছে হাতের নাগালে। ভেজিটেবল স্যুপ ২০ টাকা , কর্ন স্যুপ ২০ টাকা, স্যুপ আর নুডুলসের "মিক্সচার" ২৫ টাকা, নুডুলস ২০ টাকা, ভেজিটেবল চিকেন রাইস ৪০ টাকা, চিকেন ফ্রাই ৪০ টাকা, রাইস আর চিকেন ফ্রাই কম্বো ৭০ টাকা, ফালুদা ৪০ টাকা, পুডিং ৩০ টাকা আর কুলফির দাম ১০ টাকা মাত্র।
এত কম দাম রাখতে পারার রহস্য সম্পর্কে তুষার বলেন "আমাদের সব কাজ নিজেরাই করি। আলাদা কোনো বাবুর্চী বা কর্মচারী নেই। এলাকায় স্থানীয় হওয়ায় দোকানের ভাড়াটাও খুব কম। এজন্য খাবারের দাম কম রাখতে পারি।" দুলাল কাকার পাশাপাশি তুষার দোকানের দেখাশোনায় থাকেন সবসময়।
দুলাল স্যুপ কর্নারের আয়তন কিন্তু একেবারেই ছোট। রাস্তার পাশের ছোট্ট সেই দোকানের ভেতরে কোনোরকম দুইজন বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাকিদের রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে বা টুলে বসে খাওয়া শেষ করতে হয়। তবুও ক্রেতাদের আগ্রহের বিরাম নেই। ছোট্ট আয়োজনেও পরিচ্ছন্নতার অভাব নেই বলে সব শ্রেণীর মানুষই খেতে আসেন এখানে।
জনপ্রিয়তার পারদ বাড়তে থাকলেও দুলাল কাকার দোকানের নীতি অপরিবর্তনীয়। দোকানের খাবার দিনে একবারই রান্না করে নিয়ে আসেন বাসা থেকে। সে খাবার শেষ হয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় দোকান। এতে অনেক সময় কাস্টমার এসে খাবার না পেলেও, খাবার নষ্ট হওয়া বা পরেরদিন বাসী খাবার বিক্রির মতো ঘটনার সুযোগ পাওয়া হয় না।
দুলাল কাকার দোকানের নিয়মিত কাস্টমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র দুর্জয় চক্রবর্তী বলেন, "দুলাল কাকার এখানে আসি ৭ বছর ধরে। শুধু যে খাবারের স্বাদ আর কম দামের কারণে আসি তা-ই না, উনার ব্যবসায়িক এথিকস এর প্রতি শ্রদ্ধা থেকেও যাই। লাভের আশায় তিনি কখনো যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি খাবার তৈরি করেন না। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া তাই খাবার পাওয়াও যায় না। আবার আরও ভালো ব্যবসা হবে এরকম কিছু ভেবে দোকানের লোকেশনও চেঞ্জ করেন নি কখনো।"
বাসা থেকেই দোকানে খাবার রান্না করে নিয়ে আসেন দুলাল কাকা। স্ত্রী রেশমা, মেয়ে মীম, দুই ছেলে তুষার আর প্রেমসহ পরিবারের সব সদস্য মিলেই রান্নার কাজ সারেন। বাসায় রান্না করা হয় বলে খাবারের মানও থাকে ভালো।
দুপুরের পর তিনটা থেকে দোকান খোলা হয়। খাবার থাকা সাপেক্ষে সন্ধ্যা আটটা-নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সব আইটেম চেখে দেখতে চাইলে অবশ্যই বিকালের শুরুতেই যেতে হবে দোকানে। সপ্তাহে প্রতিদিনই খোলা থাকে দোকান।
আশেপাশের এলাকায় খাবার পার্সেলের অনেক চাহিদা থাকলেও দুলাল স্যুপ কর্নারের খাবার হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা নেই কোনো। "দোকানে এমনিতেই অনেক ভিড় থাকে। হোম ডেলিভারি দিতে গেলে দোকানের চেয়েও বাইরে অনেক বেশি বিক্রি হবে। কিন্তু নিজেরা মিলে এই ভিড় সামলিয়ে পার্সেলের ব্যবস্থা করতে পারছি না এখন," বলেন তুষার।
প্রতি বছরের শেষ দিন থার্টিফার্স্ট নাইটে দুলাল স্যুপ কর্নারে হয় বিশেষ খাবারের আয়োজন। নিজেদের বাবুর্চি দিয়ে রান্না করানো এই প্যাকেজে থাকে এক বোল জাফরানী পোলাও, চার পিস স্পেশাল মুরগীর রোস্ট, সাথে চার পিস ডিম ফ্রাই। চারজনের খাবার উপযোগী এই প্যাকেজের দাম মাত্র ৫০০ টাকা। আগে থেকেই বুকিং করে রাখতে হয় এই খাবারের জন্য। ৩১ ডিসেম্বর রাতে দোকানে গিয়ে নিয়ে আসতে হয় অর্ডার করা খাবার। এই প্যাকেজের চাহিদাও থাকে অনেক। আগে আগে বুকিং করে না রাখলে অনেককেই নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হয় খাবার না পেয়ে।
অতিরিক্ত জনপ্রিয়তায় যেন খাবারের মানের কোনো হেরফের যেন না হয় সেজন্য সবসময় সতর্ক থাকেন দুলাল কাকা। তাই তেইশ বছরের যাত্রায় কখনো বেশি উপার্জনের আশায় সাধ্যের চেয়ে অতিরিক্ত চাপ নেননি তিনি।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ড অফিসের আশেপাশের এলাকার বাসিন্দাদের জন্য দুলাল স্যুপ কর্নার দশকের পর দশক ধরে এক স্বস্তির খাবার জায়গা হয়ে আছে। শীতের হিম নামা বিকেলে দুলাল কাকার স্যুপ যেন মিষ্টি রোদের মতোই আরামদায়ক।