‘প্রশাসনের উচিত ছিল সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, খাঁচা বানানো নয়’
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্টের ঝিনুক মার্কেট সংলগ্ন এলাকা থেকে দক্ষিণে উর্মি রেস্টুরেন্টের শেষ মাথা পর্যন্ত লাল পতাকা দিয়ে ঘিরে রেখেছে প্রশাসন। দু'পাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ড। বিচ কর্মী ও ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যরা মাইকিং করে জানাচ্ছে এই জোনে একক পুরুষের প্রবেশ নিষেধ।
নারী ও শিশু পর্যটকদের জন্য আলাদা এই জোন আজ বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুর ১টায় উদ্বোধন করেছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। সৈকতের লাবনী পয়েন্টে এ জোনের দৈর্ঘ্য ৬০০ ফুট।
দুপুরে উদ্বোধনের পর বিকেল বেলায় নির্ধারিত জোনে নারী ও শিশুদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। তবে জোনটির বাইরে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পর্যটকদের সমুদ্রস্নান ও ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।
কিছুদিন আগেই স্বামী, সন্তানকে জিম্মি করে কক্সবাজারে এক গৃহবধুকে ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন নগরে নারীর নিরাপত্তাহীনতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে এ ঘটনা।
পর্যটন নগরে নিরাপত্তার ঘাটতি দূর করতেই কী আলাদা জোন-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসন বলেছে, পুরো বিচে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও, এই জোনটি শুধু একাকী নারী পর্যটক ও তাদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত। এখানে প্রবেশ সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক।
কিন্তু, দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও অধিকার কর্মীরা এ পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, "নারীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে পারে, কিন্তু নিরাপত্তার নামে তার জন্য আলাদা খাঁচা বানিয়ে নিরাপত্তাহীনতা দূর করা যাবে না। তাছাড়া, আমরা লিঙ্গ-সমতায় বিশ্বাসী। নারীপুরুষকে আলাদা করে নিরাপত্তাদানের বিষয়টি যুক্তিসঙ্গত নয়।"
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। সেখানে সবাই ছুটি কাটাতে, অবকাশ যাপনে যান। পরিবার, বন্ধু-স্বজন সবার সাথে যান। তাই শুধু একাকী নারী ও শিশুকে একটি বিশেষ এলাকায় নিরাপত্তা দেওয়া হবে, এমনটা কাম্যও নয়। নিরাপত্তা সবখানেই সবার জন্য থাকা উচিত। এটি আমাদের সাংবিধানিক অধিকার।
প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আখতার মনে করেন, নিরাপত্তা পরিবেশের উন্নতি করতে হলে চিহ্নিত দুষ্কৃতকারীদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তারা যাতে পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য হুমকি না সৃষ্টি করে, সেটা নিশ্চিত করাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগের ওই ধর্ষণের ঘটনা বিচে ঘটেনি। স্বামী-সন্তানসহ ওই নারীকে জিম্মি করে অত্যাচার করা হয়। নির্যাতনকারীরা ছিল চিহ্নিত অপরাধী। এখানে প্রশাসনের উদাসীনতা স্পষ্ট। নিরাপত্তা ত্রুটির এসব দিক সংশোধন না করে তারা ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যের আলাদা জোন বানিয়ে নিরাপত্তা দিতে পারবে না।
"আমরা এই জোনের তীব্র বিরোধিতা জানাই। মানুষ সেখানে উড়ে যাবে না। হোটেল থেকে যাবার পথেই যদি কেউ আক্রান্ত হন, তার দায়ভার কী কেউ নেবে না? নাকি শুধু ওই জোনেই নিরাপত্তা থাকবে? সবখানে যদি নিরাপত্তাই থাকে তাহলে সেদিনের ঘটনা কেন ঘটলো? আর এতো শুধু আজকের ঘটনা নয়, এর আগেও নারী পর্যটকদের হয়রানির কথা জেনেছি আমরা"- বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি- সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও দায়িত্বহীনতা থেকেই কেবল এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
এদিকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, "সৈকতে বেশি ঝুঁকিতে থাকে নারী ও শিশুরা। এবার সেই ঝুঁকি কমবে। পর্যটকদের জন্য আগে থেকেই কাজ করছি। জনবল কম হলেও আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করে যাব।"
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, "এ ধরনের উদ্যোগ পর্যটনকে আরও বেগবান করবে।"
কিন্তু, জন-সাধারণের ভেতরেই এ উদ্যোগ নিয়ে দ্বিধা ও সংশয় রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফরে আসা ঝুমা ইসলাম বলেন, "বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমরা কক্সবাজার শিক্ষা সফরে এসেছি। এখন আমি নারী জোনে যাব আর আমার সহপাঠীরা থাকবে অন্য কোথাও। এটা কেমন দেখায়। তাই আমরা সবাই একসাথে জোনের বাইরে আছি।"
আলাদা জোনের বিরোধিতায় সোচ্চার নেটিজেনরাও।
কৈলাশ সরকার নামের একজন সাংবাদিক তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, "কে এই পরিকল্পনা করলেন আর কেইবা অনুমোদন দিলেন তা আমার জানা নেই। এখন কী বিচে যাওয়া যুগল ও দম্পতিরা এক সাথে সমুদ্রস্নানও করতে পারবে না। ধর্ষণ কী বিচে হয়েছিল?"
সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক রুম্মন শিকদার তার ফেসবুক পোষ্টে লিখেছেন, "নারীকে আলাদা রাখার জন্য জায়গা তৈরি করাটা সভ্যতা নয়। এই নির্দিষ্ট এলাকাবাদে নারীরা সবখানেই অনিরাপদ, এর মাধ্যমে কী সেই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে না?"
সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা লিখেছেন, নারী পর্যটকদের জন্য আলাদা জোন তৈরির উদ্যোগ প্রশাসনের অযোগ্যতা এবং অদ্ভুত চিন্তা-ভাবনাকে তুলে ধরেছে।