তেল আমদানিতে বাংলাদেশি জাহাজ ভাড়ার নির্দেশনা বিপিসির
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) জাহাজে পরিবহনের নির্দেশনা দিয়েছে নৌ বাণিজ্য দপ্তর। বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন ২০১৯ অনুসারে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের পরিবহনের বাধ্যবাধকতার বিয়টি জানিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এদিকে বিএসসির জাহাজে তেল পরিবহন নিয়ে জ্বলানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রধান যুগ্ম সচিবকে (উন্নয়ন) আহবায়ক করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিএসসিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিন করা হয়েছে। এই কমিটি বিএসসির জাহাজে জ্বালানি তেল পরিবহনের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বলে জানিয়েছে বিপিসি সূত্র।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, "আমরা বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ সুরক্ষা আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। তবে আমাদের কাছে এর জন্য পর্যাপ্ত বাহক আছে কিনা তা বিবেচনা করা উচিত।"
বিপিসি বর্তমানে বছরে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল, অকটেন, পেট্রোলসহ পরিশোধিত জ্বলানি আমদানি করে থাকে। কুয়েত, মালয়েশিয়া, চীন, ইউএই সহ বিভিন্ন দেশের ৮ টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে তেল সরবরাহ করে। যে জাহাজে করে তেল পরিবহন করা হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে সেই জাহাজের বিস্তারিত তথ্য পাঠায়। পরবর্তীতে বিপিসির ক্লিয়ারেন্স এর ওপর ভিত্তিতে করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জাহাজ ভাড়া করে।
সম্প্রতি ২০২২ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিপিসি কর্তৃক ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ১৬ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে আমদানির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
বিপিসির তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিপিসি আমদনি করেছে ৫৯ লাখ ৬২ হাজার ৪৬৮ দশমিক ৪৬ মেট্রিক টন যার মুল্য ছিলো ৩ হাজার ৬৪৬ দশমিক ৪২৭ মার্কিন ডলার। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি করেছে ৫২ লাখ ৭৮৯ দশমিক ০৪ মেট্রিক টন, যার আমদানি ব্যয় ২ হাজার ৫৪৬ দশমিক ৮৮ মার্কিন ডলার। দেশের সার্বিক জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৮ শতাংশের যোগান আসছে স্থানীয় উৎস হতে এবং অবশিষ্ট প্রায় ৯২ শতাংশই পূরণ হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে।
ইতোমধ্যে ২০২২ সালের তেল সরবরাহ ইস্যুতে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন এবং বিএসসির জাহাজে তেল পরিবহনের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিপিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সাহেদ সরোয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জাহাজে রাষ্ট্রের টাকায় আমদানি করা তেল পরিবহন নিশ্চিত হলে দেশের টাকা দেশেই ফেরত আসবে। এটি নি:সন্দেহে দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক"
"তবে জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সেবামুলক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করতে হবে," আরও যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে বিএসসির বহরে ৮টি জাহাজ রয়েছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যুক্ত হয় ৬ টি নতুন জাহাজ। এর মধ্যে ৩ টি প্রোডাক্ট অয়েল বা ক্যামিকেল ট্যাংকার। ট্যাংকারগুলো হচ্ছে এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা, এমটি বাংলার অগ্রদূত, এমটি বাংলার অগ্রগতি। ট্যাংকারগুলোর প্রতিটির ধারণক্ষমতা ৩৯ হাজার ডেডওয়েট টন।
চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএসসির জন্য ৬টি জাহাজ নির্মাণ করে চীনের জিয়াংজু নিউ ইয়াংজি শিপ বিল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড। ওই টাকার মধ্যে চীন দিয়েছে ১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা এবং বিএসসি দিয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা।
এদিকে জাহাজ ভাড়া চুক্তি শেষ হওয়ার বিষয়টি অবহিত করে গত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন ও অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসারের কাছে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামী জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ২-৩ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকাবাহী ৩ টি প্রোডাক্ট অয়েল বা ক্যামিকেল ট্যাংকার পরবর্তী বাণিজ্যের জন্য প্রস্তুত হবে। বিষয়টি বিদেশি জাহাজ মালিক ও তাদের মনোনীত এজেন্ট এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কার্পোরেশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াসুদ্দিন আহমেদ বলেন, "ফ্ল্যাগ প্রোকেটশন আইন অনুযায়ী সরকারি তহবিলের অর্থে সমুদ্র পথে পরিবাহিত পণ্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোনো শিপিং সংস্থার মাধ্যমে পরিবহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিপিং সংস্থা হিসেবে বিএসসির জাহাজে বিপিসির তেল পরিবহনের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই সরকারিভাবে যেসব জ্বালানি তেল আমদানি হয়ে দেশে আসে, সেগুলো দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজেই পরিবহন করতে হবে।"
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসক) মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন বলেন, "বিএসসির জাহাজে তেল পরিবহনের বিষয়ে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে নৌ বাণিজ্য দপ্তর। বিএসসির বহরে আরো ৬ টি জাহাজ যুক্ত হবে, যার মধ্যে ৩ টি অয়েল ট্যাংকার। তখন ৬টি ট্যাংকারে বিপিসির তেল পরিবহনে বিএসসির সক্ষমতা বাড়বে।"