ফিরে দেখা ২০২১: এলডিসি থেকে উত্তরণে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ উদযাপনের ২০২১ সালে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের অনুমোদন পাওয়া। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও এই অর্জন 'রূপকল্প ২০২১' বাস্তবায়নে এনে দিয়েছে এক নতুনমাত্রা।
এলডিসি থেকে বের হতে নির্ধারিত শর্তগুলো পর পর দুই মেয়াদে পূরণের পরে, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে। গত ২৫ নভেম্বর জাতিসংঘে অনুমোদন পায় সেই সুপারিশ। এর মধ্যমে আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ বের হয়ে আসবে এলডিসিভুক্ত দেশের তালিকা থেকে; স্বল্পোন্নত দেশ থেকে পুরোপুরিভাবে নাম লেখাবে উন্নয়শীল দেশের তালিকায়।
নিয়ম অনুযায়ী সুপারিশ অনুমোদনের তিন বছরের মাথায়, অর্থাৎ ২০২৪ সালেই উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখানোর কথা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সময় বাড়ানো হয়েছে আরও দুই বছর।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বিভিন্ন আলোচনায় ও দরকষাকষিতে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তবে এর সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও আসবে। সেগুলো মোকাবেলা করে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতা অর্জনই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশ চড়া সুদে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ নিতে পারবে। সেই টাকা দিয়ে দেশের বড় ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এমনটি হলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে। এ পর্যন্ত বিশ্বের যতগুলো দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে সবগুলোর ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির নজির রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নতুন নতুন ব্যবসায়-বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচিত হবে, বেকারত্ব ঘুচবে লাখ লাখ মানুষের। এছাড়া, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও বাড়বে; সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।
এসব তো গেলো আশার কথা। এবারে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই সুবিধাগুলো পেতে হলে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গেই সবচেয়ে বড় যেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তা হলো, শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে (যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা থাকবে) বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে রপ্তানি খরচ বাড়ার পাশাপাশি প্রতিযোগিতাও বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রপ্তানি আয়-ব্যয়ের এই হিসাবের মাঝে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে না পারলে দেশের রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাড়তি শুল্কের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা রপ্তানি আয় হারাতে পারে।
এছাড়া, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সে সকল সুবিধা পায় সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। ঋণ নিতে হবে মোটা অঙ্কের সুদে। ফলে রপ্তানি খরচ বাড়ার পাশাপাশি ঋণের খরচও বেড়ে যাবে। সেইসঙ্গে বাড়বে জাতিসংঘের চাঁদার পরিমানও। অন্যদিকে, কমে যাবে বিদেশি অনুদান ও সাহায্য।
স্বল্পোন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সহজশর্তে বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জার্নালে নিবন্ধ ছাপানোর প্রকাশনা ফি দেওয়ার ক্ষেত্রেও পান বিশেষ ছাড়। বলা বাহুল্য, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখানোর পর বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের এসব সুযোগ-সুবিধায় বাধা আসতে পারে। এছাড়া, এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে ট্রিপস (ট্রেড রিলেটেড অ্যাস্পেক্টস অফ ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস)-এর আওতায় প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রণোদনার পাশাপাশি মেধাস্বত্বসংক্রান্ত সুবিধাও পেয়ে থাকে বাংলাদেশ, যা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরপরই বন্ধ হয়ে যাবে। আর এ কারণে হুমকির মুখে পড়তে পারে দেশের ওষুধ রপ্তানি শিল্প।
তবে এতসব চ্যালেঞ্জের মুখেও স্বস্তির কথা হলো, এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে এইসব সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে, বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে স্বনির্ভর হওয়ার পথে এগোচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য গর্বের।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে। ২০১১ সালে জাতিসংঘের চতুর্থ এলডিসি সংক্রান্ত সামিটে গৃহীত হয় 'ইস্তাম্বুল প্ল্যান অফ অ্যাকশন'। আর এর মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এলডিসি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা শুরু হয় বাংলাদেশের।
প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা-এই তিনটি সূচকের মাধ্যমে সিডিপি নির্ধারণ করে কোনো দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারলো কিনা। তিনটি সূচকের যেকোনো দুটিতে উত্তীর্ণ হয়ে, পরপর দুই মেয়াদে ওই মানদণ্ড ধরে রাখতে পারলে সেই দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। একই নিয়মের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকেও।
২০১৮ ও ২০২১ সালে, পরপর দুই মেয়াদে বাংলাদেশ উপরের তিনটি সূচকেই মানদণ্ড ধরে রাখতে পেরেছে, যা এর আগে অন্য কোনো দেশ পারেনি। এর মাধ্যমে সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের ভিত্তিতে ও জাতিসংঘের অনুমোদনের সাপেক্ষে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পা রাখবে বাংলাদেশ।