১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন বানাতে গিয়ে ৪৪৫ দিনে বছর!
গত চারশো বছর ধরে আধুনিক দুনিয়ার সিংহভাগ অঞ্চলেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ক্যালেন্ডারে রয়েছে ১২ মাস, ৩৬৫ দিনে হয় এক বছর, এবং প্রত্যেক লিপ ইয়ারে থাকে একটি অতিরিক্ত দিন — এসব তথ্য আমাদের সকলেরই জানা। আমরা আরো জানি, লিপ ইয়ার প্রতি চার বছর অন্তর আসলেও, ব্যতিক্রম সেসব বছর, যেগুলো ১০০ দিয়ে সরাসরি বিভাজ্য, কিন্তু ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য নয়।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কারকৃত সংস্করণ হিসেবে ১৫৮২ সালে পোপ অষ্টম গ্রেগরি প্রচলন ঘটান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের। এ ক্যালেন্ডার সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত, কেননা এটি সোজাসাপটা ও সহজবোধ্য। তবে ক্যালেন্ডার ব্যবহার কিন্তু এককালে এতটাও সহজ ছিল না। এমনকি একবার একটি ৪৪৫ দিনের বছরও দেখেছে বিশ্ববাসী!
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আগে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারই ছিল প্রকৃত সোলার ক্যালেন্ডার বা সৌর বর্ষপঞ্জির কাছাকাছি। এ ক্যালেন্ডারের মাধ্যমেই 'লিপ ইয়ার'-এর আগমন ঘটে, যার ফলে প্রতি চার বছর পরপর একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হতে থাকে। এর কারণ, পৃথিবীর সূর্যকে একবার পুরোপুরি কেন্দ্র করে ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দশমিক ২৫ দিন। যদিও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে পূর্ববর্তী রোমান ক্যালেন্ডারে ব্যাপক সংস্কার আসে, তারপরও এটি শতভাগ নিখুঁত ছিল না। কেননা, প্রকৃতপক্ষে সূর্য তার চক্র পূর্ণ করতে অতিরিক্ত আরো ১১ দশমিক ৫ মিনিট সময় নিয়ে থাকে। এটিকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই সামান্য পরিমাণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কথায় আছে, "ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।" সেরকমই, ষোড়শ শতকে যখন ক্যালেন্ডারে সংস্কার আনা হলো, ততদিনে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ১০ দিনেরও বেশি এগিয়ে গেছে।
মজার ব্যাপার হলো, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের নিজের জন্মও ঘটেছিল জুলিয়াস সিজারের হাত ধরে খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে, প্রাকৃতিক লুনিসোলারের ত্রুটি সংশোধন করতে। রোমান ক্যালেন্ডারের ১২ মাস হতো সর্বমোট ৩৫৫ দিনে, যা সৌরবর্ষের যে ১০ দিনের মতো কম। সূর্যের সঙ্গে গড়ে ওঠা এই ব্যবধানকে দূর করতে এক বছর পরপরই রোমান ক্যালেন্ডারে ২২ বা ২৩ দিন যোগ করা হতো, ঠিক যেভাবে আমরা লিপ ইয়ারে এক দিন যোগ করি। ফলস্বরূপ, কোনো একটি রোমান বছর ৩৫৫ দিনে হলে, পরের বছরটি হতো ৩৭৭ বা ৩৭৮ দিনে।
ব্যাপারটিকে আরো জটিল ও ঘোলাটে করে তুলতে, লিপ ডে-গুলো কোনো নিয়মিত ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যোগ হতো না। বরং এ কাজটি করা হতো পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস বা কলেজ অব পন্টিফসের প্রধান যাজকের কথা অনুসারে। অনেক সময়ই পন্টিফেক্স তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বছরের দৈর্ঘ্য একদিন বাড়িয়ে দিতেন, যখন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সিংহাসনে থাকত। ব্যাপারটি এতটাই স্বেচ্ছাচারিভাবে হতো যে, একজন গড়পড়তা ও সাধারণ রোমান নাগরিকের পক্ষে জানা সম্ভবই হতো না বছরের কোন দিনটি কয় তারিখ!
সব মিলিয়ে ক্যালেন্ডার ব্যবস্থায় এক তুমুল বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে করে ক্যালেন্ডার অনুসরণের যাবতীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছিল। তাই সিজার নগরের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও গণিতবিদদের তলব করেন, এবং তাদেরকে বলেন কোনো ধরনের মানবিক প্রভাব বাদ দিয়ে কেবল সূর্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করতে।
ওই সময় ভাবা হতো এক বছর শেষ হয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায়। তাই সিজারের গণিতবিদরা ক্যালেন্ডারের একটি সাধারণ বছরকে ৩৬৫ দিন ধরেন, এবং প্রতি বছরের ৬ ঘণ্টার ঘাটতি পুষিয়ে দিতে চার বছর পরপর একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করেন। বাস্তবতা হলো, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবী সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। তাই জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকেও পুরোপুরি নির্ভুল বলা যায় না। তারপরও এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ ঘটে।
এদিকে জুলিয়াস সিজার আরো চেয়েছিলেন নতুন ক্যালেন্ডারের নতুন বছর যেন শুরু হয় মার্চের বদলে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে। তাই তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে ৩৭৮ দিনের সঙ্গে ৬৭ দিন যোগ করেন, ফলে ওই বছরটির দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৪৪৫ দিন। সিজার ওই বছরটিকে আখ্যায়িত করেন "লাস্ট ইয়ার অব কনফিউশন" হিসেবে।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে নতুন বছর শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালের ১ জানুয়ারি। এর এক বছর পর সিজারকে হত্যা করা হয়। তারপর মার্ক অ্যান্থনি তার সম্মানার্থে কুইন্টিলিস নামের মাসটির নতুন নাম দেন জুলিয়াস (জুলাই)। পরবর্তীতে তার উত্তরাধিকারের নামে সেক্সটিলিস নামের মাসটিরও নতুন নামকরণ করা হয় অগাস্টাস (অগাস্ট)।