বিদ্যুতায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে বাড়ছে ক্যাবল শিল্পের বাজার
দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের পাশাপাশি বাড়ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও বৃহৎ কারখানার সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেরও বিকাশ ঘটছে; বড় হচ্ছে আবাসন খাত। আর শহর ও গ্রামীণ পর্যায়ে এসব উন্নয়ন যজ্ঞে বছরে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে ক্যাবল শিল্পের বাজার।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একযুগ আগেও দেশে ক্যাবলের বাজার ছিল ২ হাজার কোটি টাকার। সেখান থেকে বর্তমানে এই বাজারের পরিধি ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এগিয়ে এসেছে বড় বড় ব্র্যান্ডসহ ১২০টিরও বেশি কোম্পানি। ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে দেশের ক্যাবল খাত। তবে, সরকারি প্রজেক্টে বিদেশি কোম্পানির ক্যাবল ব্যবহার ও ননব্র্যান্ডেড ক্যাবলের কারণে বাজারে অসম প্রতিযোগীতা তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের ক্যাবল বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই এককভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। দেশের বাজারে ৩০ শতাংশের বেশি অংশীদারিত্ব থাকা এই কোম্পানিটিতে সরাসরি কাজ করছে ১০ হাজারেরও বেশি লোক। বৈদ্যুতিক সংযোগ, ইন্টারনেট, ডিশ এন্টিনাসহ সব ধরনের সংযোগ ক্যাবল উৎপাদন করছে কোম্পানিটি। তবে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরেও ফলাফলে সন্তুষ্ট হতে পারছে বিআরবি ক্যাবলস। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা ক্যাবলের ব্যবহার হতাশ করছে কোম্পানিটিকে।
বিআরবি ক্যাবলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভেজ রহমান বলেন, "দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ সংযোগের গতি দেখে অনেকেই বিনিয়োগ করেছেন। ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান। ক্যাবলের বাজার এখনও ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত আমদানি অব্যাহত থাকলে দেশীয় উদ্যোক্তারা ধরা খাবেন।"
তিনি বলেন, "সরকারি প্রকল্পগুলো যেসব দেশের অর্থায়নে বা তত্ত্বাবধায়নে হয়, তারা নিজেদের দেশ থেকে ক্যাবল নিয়ে আসে। অন্যদিকে শুল্ক পরিশোধ করে চিলি, চীন, ভারত, ওমান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর থেকে আমাদের কাঁচামাল নিয়ে আসতে হয়। ফলে আমরা প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ছি।"
বিদেশ থেকে অনেক সময়ই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে নিন্মমানের ক্যাবল আমদানি করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিআরবি ক্যাবলসের পরই বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিবিএস ক্যাবল। শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৪৭ কোটি টাকার ক্যাবল বিক্রি করেছে। বিবিএস ক্যাবলের ইউনিট-টু থেকে পৃথকভাবে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্যাবল। চলতি বছরে এই কোম্পানির প্রবৃদ্ধিও ১৫ শতাংশের বেশি রয়েছে বলে জানিয়েছেন এর কর্মকর্তারা।
বিবিএস ক্যাবলসের একজন কর্মকর্তা বলেন, "মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে হাজার কোটি টাকার কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে বিবিএস। বর্তমানে কোম্পানিটি সব ধরনের ক্যাবল উৎপাদন করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে প্রতি নিয়তই চাহিদা বাড়ছে। সরকারি প্রকল্পেও চাহিদা বাড়ছে ধীরে ধীরে।"
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমপক্ষে সাতটি গ্রেডের বৈদ্যুতিক তার পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। দামের ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা। দেশের ১২ হাজার কোটি টাকার ক্যাবলের বাজারে ৪ হাজার কোটি টাকাই আসছে বিদেশ থেকে।
স্থানীয় নির্মাতাদের উৎপাদনের মধ্যমে পুরো দেশের ক্যাবলের চাহিদা মেটানো সম্ভব হলেও, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে ক্যাবলের আদমানি করা হচ্ছে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে ঘোষণা ছাড়াই ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের ক্যাবল বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান নিন্ম মানের ননব্র্যান্ডেড ক্যাবল উৎপাদন করছে। স্থানীয় পর্যায়ে এসব ননব্র্যান্ডেড ক্যাবল বাজার ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর ব্র্যান্ডেড ক্যাবলের বাজার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল কেবলস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ আনিসুর রহমান বলেন, "দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনী উদ্যোগের পরও অনুমোদনহীন বৈদ্যুতিক ক্যাবলের উৎপাদন এবং আমদানি কমানো যাচ্ছে না। মানুষও যাচাই-বাছাই ছাড়াই কম দামের ক্যাবল কিনছে। কিছু ব্যবসায়ীর কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বুঝে পণ্য কিনতে পারেন না ক্রেতারা।"
বিআরবি এবং বিবিএস ক্যাবলসের পরই দেশের বাজারে ভালো অবস্থানে রয়েছে চার বছর আগে বাজারে আসা প্রাণ আরএফএল গ্রুপের বিজলী ক্যাবলস। কয়েক বছরের মধ্যেই বাজারের ৫ শতাংশ দখলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিজলী ক্যাবলসের মতোই বাজার অবস্থান প্যারাডাইস ক্যাবলসের। বিদেশী নিন্মমানের ক্যাবলসের সঙ্গে নিজেদের প্রতিযোগিতা করতে হয় বলে অভিযোগ করছে এ কোম্পানিগুলোও।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "আমরা ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধিতে রয়েছি। তবে সরকারি প্রকল্পে আমাদের স্থানীয় ক্যাবল ব্যবহারের সময় এসেছে।"
তিনি আরও বলেন, "সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, সরকারের বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে মেগা প্রকল্পগুলোতে বিদেশি তার ব্যবহার না করে দেশে তৈরি তার ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। তাহলে কোম্পানিগুলো টিকে থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল সাশ্রয় হবে।"
প্রযুক্তির পরিবর্তন ও নতুন বিনিয়োগ
সরকার শহরাঞ্চলের ক্যাবলের ঝঞ্জাল কমাতে সব শহরে নতুন সংযোগে ভুগর্ভস্ত ক্যাবল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের ঘোষণার পরপরই প্রায় দেড়শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে হাইভোল্টেজের মেরিন ক্যাবল উৎপাদনে নতুন কারখানা স্থাপন করেছে বিবিএস ক্যাবল।
ইউনিট-টু নামের ওই কারখানা ২০১৮ সালে উৎপাদন শুরু করে। ওই ঘোষণার পর নতুন ইউনিট স্থাপন করে মেরিন ক্যাবল উৎপাদন শুরু করে বিআরবি ক্যাবলস। সাম্প্রতিক সময়ে একই সেগমেন্ট দিয়ে বাজারে আসছে ওয়ালটন গ্রুপও। ধীরে ধীরে সব ধরনের ক্যাবল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে দেশীয় ইলেকট্রিক জায়ান্ট ওয়ালটনের।
ওয়ালটন ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্সের সিবিও সোহেল রানা বলেন, "শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে ক্যাবলের চাহিদা বাড়ছে। ওয়ালটনের নিজেদেরই বিপুল পরিমাণ ক্যাবলের প্রয়োজন। তাই এ খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হলো শিগগিরই রপ্তানি বাজারের জন্য ক্যাবল উৎপাদন করা।"
ওয়ালটন ছাড়াও বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ নিয়ে আসছে পারটেক্স গ্রুপ এবং অ্যালকো গ্রুপ।