সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন সিলেটের প্রবাসীরা, দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ নেই
আমেরিকা প্রবাসী আব্দুল আহাদের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে। বছর পাঁচেক আগে সিলেট নগরীর আম্বরখানায় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। গতমাসে এক কোটি সাত লাখ টাকায় এই বাড়িটি বিক্রি করে দেন তিনি।
সিলেটের বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা যুক্তরাজ্য প্রবাসী উস্তার মিয়া। বিনিয়োগ করেছিলেন নগরীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে। ইংল্যান্ডে তাঁর রয়েছে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। কয়েকবছর ধরেই তাঁর রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। ফলে দেশে বেসরকারি হাসপাতালের শেয়ার বিক্রি করে দেন তিনি।
কেবল আব্দুল আহাদ আর উস্তার মিয়াই নয়, সিলেটের অনেক প্রবাসীই এখন দেশ থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছেন তাদের বিনিয়োগ। বিক্রি করে দিচ্ছেন নিজেদের সম্পদ। দেশের সম্পদ বিক্রিতে যুক্তরাজ্য প্রবাসীরাই সবচেয়ে এগিয়ে।
প্রবাসী বহুল অঞ্চল সিলেট। এই অঞ্চলের প্রবাসীদের বেশিরভাগই যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। সিলেট চেম্বার অব কমার্স থেকে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে ইংল্যান্ডে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বাস করেন। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশই সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। সিলেট বিভাগের প্রায় ১৬ শতাংশ পরিবার প্রবাসী অর্থের ওপর নির্ভশীল।
এসব প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে চেম্বার অব কমার্সসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে এতে তেমন সুফল মিলছে না। দেশে বিনিয়োগে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না প্রবাসীরা। উপরন্তু দেশের বিনিয়োগ ও সম্প্রতি বিক্রি করে টাকা প্রবাসে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সিলেটের অর্থনীতি আর জীবন মানেও। কমে গেছে সিলেটের জমির দাম।
সিলেটের বেশ কয়েকজন প্রবাসী, প্রবাসীদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দেশে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়া, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রবাসে ব্যবসার মন্দা, প্রবাসীদের নতুন প্রজন্মের দেশের প্রতি আগ্রহ না থাকা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছেন প্রবাসীরা। এসব কারণে অনেকে দেশের সম্পদ বিক্রিও করে দিচ্ছেন।
সিলেটে প্রবাসীদের সেবাদান করে থাকে সিলেট ওভারসিজ সেন্টার। এই প্রতিষ্ঠানের ওয়েল ফেয়ার অফিসার মো. আব্দুল মোছাব্বির বলেন, আমাদের প্রায়ই অনেক প্রবাসী আসেন, যাদের সিলেটে ব্যবসা বা সম্পত্তি রয়েছে, এগুলো বিক্রি তারা বিক্রির জন্য পরামর্শ চাইতে আসেন।
মোছাব্বির বলেন, দেশের ব্যবসা থেকে লাভ না পাওয়া, জমিজমা নিয়ে স্বজনদের কাছে প্রতারিত হওয়া এবং তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসীদের দেশের প্রতি আগ্রহ না থাকার কারণেই সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলতে চান বেশিরভাগ প্রবাসী।
জানা যায়, প্রায় এক যুগ আগে সিলেটে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার হিড়িক পড়ে। ২/৩ বছরে সিলেটে গড়ে ওঠে শতাধিক আবাসন প্রকল্প। এসব আবাসন প্রকল্পে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেন প্রবাসীরা। তবে বেশিরভাগ প্রকল্পই লাভের মুখ দেখতে পারেনি। অনেকে ইতোমধ্যে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদেও কার্যক্রম। কিছু কিছু প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের টাকা নিয়ে প্রতারণারও অভিযোগ ওঠেছে। এই সময়কালেই যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। যার প্রভাব পড়ে সেসব দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের উপরও। তাদের অনেকে এখনো মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এরমধ্যে শুরু হয় করোনার ধাক্কা। তবে করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে থেকেই সিলেটের প্রবাসীরা দেশের সম্পদ বিক্রি করা শুরু করেন।
প্রতারিত হওয়া ও কাঙ্ক্ষিত লাভ না পাওয়ার কারণে অনেক প্রবাসী দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। যুক্তরাজ্যে ব্যবসায়ীক মন্দার কারণেও তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন দেশের সম্পদ।
সিলেটের আবাসন প্রতিষ্ঠান আর্ক রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলওয়ার হোসাইন বলেন, অনেক প্রবাসীই এখন দেশ থেকে তাদের বিনয়োগ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা প্রবাসীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।
বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি প্রবাসের নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের দেশের প্রতি আগ্রহ না থাকার কারণে দেশের সম্পদ তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
দেলওয়ার হোসাইন বলেন, আমার পরিচিত এক যুক্তরাজ্য প্রবাসী নগরীর উপকণ্ঠে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন ছুটিতে দেশে এসে থাকার জন্য। কিন্তু তার ছেলেমেয়েরা দেশে আসতে আগ্রহী নন। ছেলেমেয়েদের চাপে নির্মানকাজ শেষেই তিনি বাড়িটি বিক্রি করে দেন। একদিনও এসে থাকেননি। এখন অনেক প্রবাসীই এরকম সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
দেশে বিনিয়োগ করে লাভবান হয়েছেন প্রবাসী ফাহিম আহমদ চৌধুরী। বর্তমানে বারাকা পাওয়ারের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচলাক (ডিএমডি)-এর দায়িত্বে আছেন তিনি। ফাহিম বলেন, সিলেটে বিভিন্নক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে অনেক প্রবাসী লাভ তো দূরে থাক বিনিয়োগের অর্ধেকও ফেরত পান না। প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অনেকক্ষেত্রে তাদের প্রতারিত করা হয়। ফলে প্রবাসীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এছাড়া প্রবাসীদের নতুন প্রজন্মেরও বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা আছে। এখানে হয়রানি হয়, বিনিয়োগ করতে গেলে ঝামেলায় পড়তে হয়- এমনটি ধারণা তাদের। তাছাড়া তাদের কাছে আমরা পৌঁছাতেও পারছি না।
তিনি বলেন, অর্থে, মেধায়, দক্ষতায় প্রবাসীদের এই নতুন প্রজন্ম অনেক এগিয়ে। তাদের দেশের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। দেশে নিয়ে আসতে হবে। নতুবা আগামীতে সিলেট ও দেশের অর্থনীতির জন্য তা আরও দুঃসংবাদ বয়ে আনবে।
সিলেটে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এলাইছ মিয়া মতিনের। নগরীতে রয়েছে জায়গাজমিও। এসব সম্পদ বিক্রির জন্য প্রায়ই দেশে আসেন মতিন। সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে ব্যবসার অবস্থা ভালো না। তাছাড়া দেশে সম্পদ রক্ষণাবেক্ষনের কেউ নেই। বরং বেদখল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। ফলে উপদ্রপ এড়াতে এগুলো বিক্রি করে ফেলতে চাই।
প্রবাসীদের নতুন প্রজন্মের দেশের প্রতি অনাগ্রহের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে জানান সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব। তিনি বলেন, আগে শীতে, ঈদের মৌসুমে প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী সিলেট আসতেন। এখন এ সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। নতুন প্রজন্মের প্রবাসীরা ছুটিতে আর দেশে আসছেন না। তারা অন্যান্য দেশে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন।
শোয়েব বলেন, আগে সিলেটে জমির ক্রেতা ছিলেন মূলত প্রবাসীরা। কিন্তু তারা আর জমি কিনছেন না। উল্টো নিজেদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে গত এক দশকে সিলেটে জমির দাম প্রচুর কমে গেছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সিলেটের অর্থনীতিতে। কারণ এখানকার অর্থনীতির অনেকটাই প্রবাসীদের উপর নির্ভশীল।'
প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে চেম্বার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিলেটে পর্যটন ও আইটি সেক্টরে বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা এসব সম্ভাবনার দিক নিয়ে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছি। ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের এ সংক্রান্ত একটি পেপার তৈরি করা হয়েছে। এটি নিয়ে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের কাছে যাবো। আশা করছি তাতে কিছু সাড়া মিলবে।
বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের পরিচালক জুলিয়া জেসমিন মিলি বলেন, সিলেটের প্রচুর সংখ্যক প্রবাসীর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যংকে পড়ে আছে। এছাড়া সিলেটে কয়েকটি সেক্টরে বিনিয়োগ খুবই সম্ভাবনাময়। এগুলোতে প্রবাসীরা বিনিয়োগ করতে পারেন। বিনিয়োগ বোর্ড তাদের সব ধরনের সেবা প্রদানে প্রস্তুত রয়েছে।