মেটাভার্সের অন্ধকার দিক: যৌনতা, হয়রানি, অনাহূত আক্রমণ
গেম খেলার জন্য কিছুদিন আগে সোফিয়া একটি ভিআর হেডসেট কিনেন। সেটি পরে নিজের প্রিয় গেম পপুলেশন ওয়ান খেলতে দিয়ে খুবই ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার।
গেমে একটি লবিতে নিজের ভার্চুয়াল অবতার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সোফিয়া। এই অপেক্ষার মাঝেই অন্য একজন খেলোয়াড়ের অবতার এসে দাঁড়ায় তার সামনে। কোনো বাক্যবিনিময় না করেই সে ব্যক্তি তার অবতারের গায়ে হাত দেয়, এমনকি গায়ে বীর্যপাত করা শুরু করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক সোফিয়া সেই ব্যক্তিকে (এবং তার অবতারকে) থামতে অনুরোধ করেন।
"কিন্তু সে কিছু না বলে শুধু ঘাড় ঝাঁকায়, যেন সে বলতে চাইছে, 'এটা মেটাভার্স, এখানে যা করতে মন চায় করবো আমি," বলেন ২৯ বছর বয়সী সোফিয়া।
মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক; বিশ্বের বড় বড় সব প্রযুক্তি কোম্পানিই 'মেটাভার্স' তৈরির দৌড়ে নেমেছে। মেটাভার্স একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জগত যার উদ্দেশ্য ইন্টারনেটকে প্রাণ দেওয়া। এখানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট বা অগমেন্টেড রিয়েলিটি চশমা পরে মানুষ নিজের অবতারকে নিয়ে ভিডিও গেম খেলা, মিটিংয়ে অংশ নেওয়া, শপিং করা থেকে শুরু করে সবকিছুই করতে পারবে।
অক্টোবরে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ বলেন, তিনি মেটাভার্সে এতটাই বিশ্বাস করেন যে এই খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন বিনিয়োগ করবেন তিনি। জাকারবার্গ নিজের কোম্পানির নামই পরিবর্তন করে রেখেছেন 'মেটা'।
এই বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মেটাভার্স নির্মাণের চিন্তাতে বুদ হয়ে থাকলেও এই কল্পিত জগতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ইতোমধ্যেই। গবেষকরা বলছেন, মেটাভার্সে থাকা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেমগুলো হামলা, হেনস্তা, গুণ্ডামি এবং ঘৃণাত্মক কথাবার্তায় ছেয়ে গেছে। আর এসব দুর্ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ জানানোর সুযোগও বেশ সীমিত, প্রতিকার তো নেই বললেই চলে।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, জনপ্রিয় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেম, ভিআরচ্যাটে প্রতি সাত মিনিটে একটি নীতিবিরুদ্ধ ঘটনা ঘটে।
আজকের অনলাইন হয়রানি এবং নিপীড়নের চেয়ে মেটাভার্সের দুর্ব্যবহার অনেক বেশি গুরুতর হতে পারে। কারণ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মানুষের পুরো সত্ত্বাকে একটি ডিজিটাল পরিবেশে নিমজ্জিত করে। যার ফলে ডিজিটাল জগতের যেকোনো অবাঞ্ছিত স্পর্শ আপনার কাছে বাস্তবের মতোই লাগবে।
"যখন খারাপ কিছু ঘটে, যখন কেউ এসে আপনাকে বাজেভাবে স্পর্শ করে, তখন আপনার মন আপনাকে এটা ভাবতে প্ররোচিত করে যে এটি বাস্তব জগতে ঘটছে। মেটাভার্স সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এই অনুভূতি আরও তীব্র হবে," বলেন সোফিয়া।
গেমিং এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে এরকম বাজে আচরণ নতুন না। কিন্তু মেটা এবং অন্যান্য বড় কোম্পানিগুলো যেহেতু মেটাভার্সকে তাদের ভবিষ্যতের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড় করাতে যাচ্ছে, সেখানে কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণে এই সমস্যাগুলো নিঃসন্দেহে আরও বড় আকার ধারণ করবে।
জাকারবার্গ যদিও দাবি করেছেন মেটাভার্সের অন্ধকার দিকগুলোর ব্যাপারে তিনি ভালোই সচেতন, এবং মানুষের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এই জগতকে তৈরি করবেন তিনি। কিন্তু তার নিজের সহযোগীরাই বলছেন, এই ভার্চুয়াল জগতে কীভাবে মানুষের বিষাক্ত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা নিয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই তাদের।
গত মার্চে মেটার নির্বাহী সদস্য ও ভবিষ্যৎ প্রধান টেকনোলজি অফিসার অ্যান্ড্রু বসওয়ার্থ এক কর্মচারী মেমোতে লিখেন, মেটাভার্সে মানুষ কী বলবে এবং করবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা "কার্যতভাবে অসম্ভব।"
ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে কারো দুর্ব্যবহার শনাক্ত করাটা বেশ কঠিন। কেননা, এখানে সবকিছু বাস্তব সময়েই ঘটে এবং ঘটনাগুলো সাধারণত রেকর্ড করা হয় না।
মেটাভার্সের আরেকটি বড় উদ্বেগ হচ্ছে শিশুদের নিরাপত্তা। ইন্টারনেটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শিশুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাকারী অ্যাপ 'বার্ক'-এর প্রধান অভিভাবক কর্মকর্তা, টাইটানিয়া জর্ডান বলেন, মেটাভার্সে একটি গেমের চ্যাট বার্তা বা হেডসেটের মাধ্যমে শিশুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারবে অপরাধীরা, যেটি নথিভুক্ত করাও কঠিন।
সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিজিটাল হেট-এর গবেষণা দলের প্রধান, ক্যালাম হুড সম্প্রতি ওকুলাস হেডসেটে খেলা একটি ভিআরচ্যাট গেমে কয়েক সপ্তাহ ধরে মানুষের মিথষ্ক্রিয়া রেকর্ড করেছেন।
এই গেমটিতে মানুষ ভার্চুয়াল সম্প্রদায় গঠন করতে পারে। এবং তাদের অবতারের মাধ্যমে কার্ড খেলতে পারে, ভার্চুয়াল ক্লাব ও অন্যান্য জায়গায় পার্টি করতে বা আড্ডা দিতে পারে। ওকুলাস এই গেমকে কিশোর-কিশোরীদের জন্য নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছিল।
কিন্তু পর্যবেক্ষণ শুরু করার ১১ ঘণ্টার মধ্যে হুড শতাধিক আপত্তিকর ঘটনা রেকর্ড করেন। এর মধ্যে কিছু অভিযোগ এসেছে ১৩'র চেয়েও কম বয়সী ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই কমবয়স্ক গেমাররা যৌন এবং সহিংস হুমকি পেয়েছে বলে অভিযোগ এনেছে।
হুড বলেন, "ভিআরচ্যাট মোটেও নিরাপদ না। কারণ অসাধু ব্যবহারকারীরা যেন তাদের পরিষেবাগুলোর সুযোগ না নিতে পারেন সেটি নিশ্চিত করতে কোনো মৌলিক ব্যবস্থাও নেয়নি ফেসবুক এবং এর ডেভেলপাররা। তারা অপ্রাপ্তবয়স্কদের মেটাভার্সে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, আবার এই মেটাভার্সকে অপব্যবহারকারীদের জন্যও একটি নিরাপদ স্বর্গ হিসেবে গড়ে তুলছে।"
পপুলেশন ওয়ান খেলতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর সোফিয়া নারীদের একটি ভার্চুয়াল সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দেন। গেমারদের এই সাপোর্ট গ্রুপের সদস্যরা জানান, তারাও নিয়মিত হয়রানির শিকার হন।
গত জুনে পপুলেশন ওয়ানের বিকাশকারী প্রতিষ্ঠান বিগবক্স ভিআরকে কিনে নেয় জাকারবার্গের মেটা।
সাপোর্ট গ্রুপের আরেক সদস্য, ম্যারি ডিগ্রাজিয়া (৪৮) বলেন, সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিনবার পপুলেশন ওয়ানে হয়রানি ও হামলার ঘটনা দেখেন তিনি।
"কখনও কখনও দিনে দুই থেকে তিনবার এসব কর্মকাণ্ড দেখতে হয় আমাদের," যোগ করেন তিনি।
ম্যারি জানান, পপুলেশন ওয়ান গেম কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন তিনি। এবং তারা সেসব অভিযোগে সাড়া দিয়ে গেমটিকে আরও নিরাপদ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তাকে।
ম্যারি বলেন, তিনি ভার্চুয়াল বন্ধুদের একটি সম্প্রদায় খুঁজে পেয়েছেন যাদের সাথে এখন নিয়মিত গেমটি খেলেন। শত হয়রানি সত্ত্বেও গেম খেলা ছেড়ে দিতে চান না তিনি।
"আমি খেলা বন্ধ করে দিব না। কারণ আমি মনে করি, এই গেমে নারীসহ বিভিন্ন ঘরানার মানুষের অংশগ্রহণ করাটা জরুরী। তারা আমাদের ঠেলে বের করে দিতে পারবে না। যদিও মাঝে মাঝে থেকে যাওয়াটা খুবই কঠিন মনে হয়," বলেন তিনি।
গত জুলাইয়ে একটি হ্যাপটিক ভেস্ট কিনেন ম্যারি। এই ভেস্ট কম্পনের মাধ্যমে আমাদের শরীরে সংবেদন ছড়িয়ে দেয়, যা প্রায় বাস্তবের মতোই। ভেস্ট পরে পপুলেশন ওয়ান খেলতে গিয়ে ম্যারিও সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। আরেকজন খেলোয়াড় তার অবতারের বুক চেপে ধরেন।
ম্যারি বলেন, "জাকারবার্গ এমন এক মেটাভার্সের বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে মানুষের পুরো শরীরেই সংবেদনশীল বডি স্যুট লাগানো থাকবে, যা বাস্তবের মতো অনুভূতি দিবে। সেই জগতের চিন্তাটাই আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।"
সোফিয়া জানান, শেষ পর্যন্ত গেমের মধ্যে একটি ফর্মে যে ব্যক্তি তাকে হয়রানি করেছিল তার অ্যাকাউন্টের বিষয়ে রিপোর্ট করেছিলেন তিনি। রিপোর্ট করার পর গেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে জানানো হয়, ওই ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
"আমি জানি না তাকে একদিনের জন্য বা এক সপ্তাহের জন্য বা আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু শাস্তি যাই হোক না কেন, এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে," বলেন সোফিয়া।
তিনি জানান, প্রথম যৌন নিপীড়নের ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে আবার একইভাবে তার অবতারের উপর নিপীড়ন চালায় আরেকজন।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।