বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি-প্রক্টর-প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীবান্ধব হন না কেন?
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে আচরণ করলো, তাকে কোনো যুক্তিতেই 'শিক্ষকসুলভ' বলা যায় না; 'পিতৃতুল্য অভিভাবকসুলভ' তো অনেক দূরের ব্যাপার। শাবিপ্রবি'র প্রশাসন শিক্ষার্থীদের খুবই সাধারণ কিছু দাবি মানার মতো, এমনকি ঠিকঠাক করে শোনার মতো সহিষ্ণুতাও দেখাতে পারেনি। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার নির্দেশ দিয়ে রীতিমতো 'ক্রিমিনাল অফেন্স' করেছে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট এমনকি সাউন্ড গ্রেনেড পর্যন্ত প্রয়োগ করেছে। রক্তাক্ত করে হাসপাতালের আইসিইউতে পাঠিয়েছে শিক্ষার্থীদের।
কিন্তু গোড়া থেকে দেখলে দেখা যাবে, বিষয়টার শুরু খুব সাধারণ কিছু দাবী উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। শাবিপ্রবি'র সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা তাদের হলের ডাইনিংয়ের খাবারের মান বৃদ্ধি, সিট বণ্টনে স্বচ্ছতা, ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোসহ কিছু দাবি জানায় হল প্রভোস্টের কাছে। প্রভোস্ট সেসব দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া তো দূরের কথা, আশ্বাস পর্যন্ত দেননি। উল্টো অশালীন-অশোভন দুর্ব্যবহার পেয়েছে ছাত্রীরা। ফলে, স্বভাবতই হলের ছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে, তাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়। আন্দোলনে এক পর্যায়ে ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ হামলার চেষ্টা চালায়। পরবর্তীতে আন্দোলন আরো তীব্র হলে শাবিপ্রবি প্রশাসন পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেয়। ব্যাপকভাবে নির্যাতন করা হয় শিক্ষার্থীদের ওপর, ফলশ্রুতিতে ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় প্রশাসন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছাড়েনি, ভিসি'র পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে! মোটাদাগে এই হলো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা 'ঘটনাপ্রবাহ'।
এবার আসুন, কয়েকটা 'কেন' নিয়ে কথা বলি। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। ছাত্রীদের অতি সাধারণ দাবিগুলো হল প্রশাসন মানলো না কেন? আন্দোলনে ছাত্রলীগ হামলা করতে এলো কেন? পুলিশ ডাকলো কেনো? পুলিশকে হামলার নির্দেশ দেয়া হলো কেন? ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা দিলো কেন? পুলিশ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করলো কেন? এবং সবচেয়ে বড় 'কেন' হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি-প্রক্টর-প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীবান্ধব হন না কেন?
শেষ 'কেন'র উত্তরের মধ্যেই বাকি সকল 'কেন'র উত্তর মিলবে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীবান্ধব ভিসি, প্রশাসন নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শামসুজ্জোহা স্যারের নাম আমরা সকলেই জানি। যিনি শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে নিজে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। সেটা বাংলাদেশ জন্মের আগের ইতিহাস। কথা ছিলো- নতুন দেশে জোহা স্যারের মতো হাজার হাজার শিক্ষক জন্ম নিবেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারকির দায়িত্ব পাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ পাবে, জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
পরিতাপের বিষয়, হয়েছে ঠিক তার উল্টো। যতদিন যাচ্ছে, ততোই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকসুলভ বৈশিষ্ট যাদের নাই, তারাই প্রশাসনের দায়িত্ব পাচ্ছেন। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকতার অবস্থা যতো নিম্নগামী হচ্ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তার গণতান্ত্রিক পরিবেশ হারাচ্ছে। ঘটনাটা মর্মান্তিক হলেও কারণটা খুব পরিষ্কার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠান নয়; ফলে রাষ্ট্রের চরিত্র-আচরণ বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়বে স্বাভাবিকভাবেই। একজন ভিসি, কিংবা প্রক্টর, কিংবা হলের প্রভোস্ট যেভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন- তাতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, অন্যান্য শিক্ষকদেরই কোনো মতামতের সুযোগ নাই। তথাকথিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রপতি (যিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। আসলে সরকার প্রধান যাদেরকে 'আপন লোক' মনে করে তাঁকেই বসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'শাসক' হিসেবে; তাদেরকে আদর করে সম্বোধন করা হয়- 'ভিসি'।
সরকার তার পছন্দের 'লোক'দেরকে (যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে সমাজে পরিচিত করা হয়) কেন বসায়? এর উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সকল কাহিনী। যেহেতু ভিসির নিয়োগে তার অন্যান্য কলিগদের কোনো মতামত থাকে না, শিক্ষার্থীদের কোন অংশগ্রহণ থাকে না; সেহেতু তিনি তাদের প্রতি কোনো দায়িত্বও অনুভব করেন না, থাকে না কোন জবাবদিহিও। ওইসকল ভিসি-প্রক্টরদের দায় থাকে শুধু সরকারের কাছে জবাবদিহি করার। সরকার খুশি থাকলে, এমনকি ক্যাম্পাসে মাসের পর মাস না গিয়েও ভিসি থাকা যায়, তার উদাহরণ আমরা দেখেছি।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর 'ভিসি' মহোদয়বৃন্দ 'ক্ষমতাসীন সরকারের দর্শন'কেই তাঁর ক্যাম্পাসে কার্যকর করেন। শাবিপ্রবি'র কথাই ধরেন- হয়তো খুব সহজেই ইস্যুটার সমাধান করা যেত, ছাত্রীদের সাথে আলোচনা করে সমাধানের জন্য এমনকি সময়ও নেয়া যেত। কিন্তু তা করা হলো না। প্রথমে প্রশাসনের অনুগত ছাত্র সংগঠন বাধা দিতে এলো। তাতে যখন দমানো গেলো না, তখন ডাকা হলো সরকারি বাহিনী। এরপর ভবিষ্যতে আরো দমন-নির্যাতনের জন্য নির্যাতিত-আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই দেয়া হলো মামলা। যদিও মামলা হবার কথা হুকুমের আসামী হিসেবে ভিসির বিরুদ্ধেই, হামলাকারী হিসেবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। এই একই ধরনের সমীকরণ আমরা অন্যান্য সকল আন্দোলন-সংগ্রামে দেখতে পাবো। প্রথমে ছাত্র সংগঠন, তারপর সরকারি বাহিনী, তারপর মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানী।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গণতান্ত্রিক করতে রাষ্ট্রকে যে গণতান্ত্রিক হতে হবে, তা বলা বাহুল্য। তবে এটাও ঠিক যে, বিশ্ববিদ্যালয়েরও দায় আছে, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই তাকে নিজেকেই গণতান্ত্রিক করতে উদ্যোগী হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পক্ষকেই এই বিষয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রমে যুক্ত করা যায়, তাও ভাবতে হবে। এমনকি ভিসি-প্রক্টর-প্রভোস্ট-হাউস টিউটর নিয়োগের ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা দরকার। কারণটা কিন্তু খুবই সোজা- শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অংশ, প্রধান পক্ষ; তাদের জন্যই সকল আয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে- কিভাবে যুক্ত করা যায় শিক্ষার্থীদের? প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হলো- শিক্ষার্থীদের দ্বারা 'শিক্ষক মূল্যায়নের ব্যবস্থা' করা, সেটা সকল ধাপেই।
একজন শিক্ষক প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক ও পরবর্তীতে অধ্যাপক হতে গেলে তাঁর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট অর্জন করার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। পাশাপাশি থাকতে হবে, গবেষণা ক্ষেত্রে অবদানের পয়েন্ট। এবং একজন হাউস টিউটর তাঁর হলের ছাত্রদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তীতে প্রভোস্ট হবার আবেদন করতে পারবেন। সেই মূল্যায়নেই ফুটে উঠবে, হাউস টিউটর থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সাথে তাঁর আচরণ-দায়িত্বশীলতা-জবাবদিহিতা কেমন ছিলো। এবং প্রভোস্ট হবার ক্ষেত্রে তা একটা বড় প্যারামিটার আকারে বিবেচ্য হবে। প্রক্টর হবার জন্য তাকে একাধিক হলের হাউস টিউটর ও প্রভোস্ট থাকার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে উচ্চ পয়েন্ট অর্জন করতে হবে। যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেন। ভিসি হবার জন্য গবেষণায় অবদানের পাশাপাশি, শিক্ষকদের দ্বারা মূল্যায়ন ও ইতিমধ্যে সকল স্তরে শিক্ষার্থীদের দ্বারা মূল্যায়নে ভালো পয়েন্ট থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এইসব ব্যবস্থা থাকলে একজন ভিসি বা প্রক্টর বা প্রভোস্ট সকলেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে বাধ্য থাকবেন, এবং ইতিমধ্যেই যেহেতু তাঁদের বিষয়ে অন্যান্য পক্ষ ইতিবাচক মূল্যায়ন করেছেন, ফলে দায়িত্ব পেয়েও তিনি দায়িত্বশীলই থাকবেন বলেও ধরে নেয়া যায়। আর যদি কোনো কারণে দায়িত্বে অবহেলার কোনো ঘটনা ঘটে যায়, তবে অন্যান্য পক্ষের সমর্থন প্রত্যাহার করার অধিকার থাকবে। অর্থাৎ মোদ্দাকথা হলো- বিশ্ববিদ্যালয় চলবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব 'শাসনে', যাকে বলে 'স্বায়ত্বশাসন'। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে এটা একেবারেই প্রাথমিক পদক্ষেপ।
শাবিপ্রবি'র শিক্ষার্থীরা হয়তো মর্মবস্তুতে তাদের আন্দোলনের কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের 'মালিকানা'র কথাই বলতে চাইছে; বিপরীতভাবে প্রশাসনের একক মালিকানার উচ্ছেদ চাইছে। শুধু শাবিপ্রবি'তে নয়, সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি একই 'অগণতান্ত্রিক পরিবেশ' বিরাজ করছে, সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের রাজত্বে 'প্রজা'র মতোই বসবাস করে; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোনো কর্তৃত্ব নেই, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাড়া। এই অগণতান্ত্রিকতার উৎস অনেক গভীরে।
শাবিপ্রবি'র শিক্ষার্থীদেরকে তাদের লড়াকু তেজকে অভিনন্দন জানাতেই হবে। হল ছাড়ার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, যেভাবে শিক্ষকদেরকে ক্যাম্পাস ছাড়ার পাল্টা আহবান জানিয়েছে; তাতে একথা বলাই যায় যে, শাবিপ্রবি 'ভয়হীনতার নতুন ইতিহাস' নির্মাণ করছে। ওরাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান 'স্টেক হোল্ডার' সেটা ওই 'পাইক-বরকন্দাজ'দের বুঝিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভয়হীনতা ও মালিকানার বোধই পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে 'গণতান্ত্রিক পরিবেশ' ফিরিয়ে আনতে।
- লেখক: রাজনৈতিক কর্মী।