চিতার ক্ষুদ্রতম প্রজাতি, কোনোমতে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে ওমানের পাহাড়ি এলাকায়
ওমানের সামহান পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে জাবাল সামহান প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চল। এলাকাটি সবচেয়ে বিরল বাঘ বা বিড়াল প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।
উঁচু, খাড়া ও দুর্গম এ অঞ্চলটি দক্ষিণ ওমানের দোফারে অবস্থিত। সামহানের পাহাড়ি এলাকাটি যেন বন্যপ্রাণী সংকুল আলাদা এক পৃথিবী। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী সালালাহ শহরটিকে আরব সাগরের ওপাড় থেকেও দেখা যায়।
আরব সাগরের উপকূলবর্তী মরুভূমি এলাকা বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষার শুরুতে নিকটবর্তী মরু এলাকা সবুজ রঙ ধারণ করে। নদী, হ্রদ ও ঝর্ণাগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিন্তু জাবাল সামহানের চূড়ার রুক্ষ অঞ্চলে কোনোরকম পরিবর্তন ঘটে না। আর ঠিক এখানেই চিতাগুলো গড়ে তুলেছে তাদের আবাসভূমি।
চিতার আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে অ্যারাবিয়ান চিতাই সবচেয়ে দুর্লভ। বনভূমিতে প্রাপ্তবয়স্ক চিতার সংখ্যা ২০০'রও কম। আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ইউনিয়ন (আইইউসিএন)-এর ক্যাট স্পেশালিস্ট গ্রুপের কো-চেয়ার উরস ব্রেইটেনমোসার এসব কথা বলেন।
বাঘ সমীক্ষার এ কাজটি পুরোপুরি চোখে দেখে করা কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লুকায়িত ক্যামেরা বা ক্যামেরা ট্র্যাপের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
একসময় চিতার এ প্রজাতিটি পুরো আরব উপদ্বীপ জুড়ে বাস করলেও ইদানীং মাত্র কয়েকটি জায়গায় এদের দেখা যায়। আইইউসিএন-এর তালিকা অনুসারে বর্তমানে ওমান, ইয়েমেন, সৌদি আরব এবং খুব সম্ভবত ইসরাইলে এই চিতাটির আনাগোনা আছে।
মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষ, শিকারী প্রজাতিগুলোকে মেরে ফেলার প্রবণতা, বাসস্থান সংকট এসব কারণে অ্যারাবিয়ান চিতার সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। তবুও নিবেদিতপ্রাণ সংরক্ষণবাদীরা বাঘ-চিতা-সিংহের বিলুপ্তি ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অ্যারাবিয়ান চিতার শেষ আশ্রয়স্থল
এনভায়রনমেন্টাল অথোরিটির সালালাহ-য় অবস্থিত কার্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল অ্যাফেয়ার্সের ব্যবস্থাপক হাদি আল হিকমানির মতে ওমানকে অ্যারাবিয়ান চিতার সবচেয়ে বড় আবাসস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধোফারের জাবাল সামহান, জাবাল কারা ও জাবাল কামারের মতো পাহাড়ি এলাকাগুলোয় মোটামুটি ৫০টির মতো পূর্ণবয়স্ক চিতা আছে। ৪৫০০ বর্গ কিমি-এর জাবাল সামহান প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চলের ভেতর ২০ থেকে ৩০ টি প্রাপ্তবয়স্ক চিতা আনাগোনা করে।
আল হিকমানি দুই বছর আগে রক্তমাংসের চিতা দেখেছিলেন। তিনি বলেন, এটি আসলেই লজ্জার – একটি চিতা প্রায় ১৫০ বর্গ কিমি এলাকার মধ্যে চরিয়ে বেড়ায় আর সংরক্ষণ কেন্দ্রে চিতাগুলোকে দেখার জন্য মাত্র ২০ জন লোক রাখা হয়েছে।'
'চিতার দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর। একমাত্র প্রযুক্তির সাহায্যেই যেমন, ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে বা বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে এদের পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।'
ঐতিহ্যগতভাবে মেষপালক বা খামারিরা তাদের পশুর দলকে বাঁচাতে চিতাকে বিষপ্রয়োগ করে, ফাঁদ পেতে নাহলে গুলি করে মারার চেষ্টা করে। তবে, ওমানে ১৯৭৬ সালে চিতা বা তার শিকারকে মারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বর্তমানে ওমান আরবীয় চিতা সংরক্ষণে সোচ্চার। সরকার ২০১৪ সাল থেকে পশুপালকদের চিতার আহার হওয়া পশুগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু করেছে। চিতার ব্যাপারে মানুষের বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে পরিবর্তনের জন্য শিক্ষামূলক কার্যক্রমও হাতে নেওয়া হয়েছে।
আল হিকমানি বলেন, 'আমরা মানুষকে শাস্তি দিতে নয়, মানুষকে সাথে নিয়ে এই বন্যপশুদের রক্ষা করতে চাই।'
আল হিকমানি বংশপরম্পরায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সাথে জড়িত। জাবাল সামহানের আশেপাশে গুটিকয়েক যে কয় ব্যক্তি উট চরান হিকমানির বাবা তাদের মধ্যে একজন।
এ ব্যাপারে অ্যান্ড্রু স্পালটন বলেন, 'চল্লিশ বছর আগেও যেকোন চিতাকে গুলি করতে তার হাত কাঁপত না। আজ তারই ছেলে চিতা সংরক্ষণ কার্যক্রমে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।'
স্পালটন একজন অবসরপ্রাপ্ত সংরক্ষণবাদী এবং ওমান সরকারের একজন সাবেক পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা। একটি ফ্লিল্ডওয়ার্কের কাজে '৯০ এর দশকে তার সাথে হিকমানির পরিচয় হয়েছিল। গবেষণার যন্ত্রপাতি বয়ে নেওয়ার জন্য তার একটি উটের দরকার হলে হিকমানি তার উটে করে সেগুলো বয়ে নিয়ে যায়।
পড়াশোনা শেষ করে হিকমানি স্পালটনের অ্যারাবিয়ান চিতার জরিপ কাজে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগদান করে। পরে সংরক্ষণবাদী হিসেবে সরকারের জন্যেও তিনি কাজ করেছিলেন, একটি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং ওমানের বন্যজীবন ও চিতার ওপরে কয়েকটি বইয়ের সহ-রচয়িতা হিসেবে কাজ করেন।
ওমানে আরবীয় চিতা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রমগুলো মোটামুটি সফল। সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও চিতাগুলো তুলনামূলক ভালোভাবে নিজেদের সংখ্যা ও আবাসস্থলের পরিসর দিনদিন বাড়িয়ে চলছে। তবুও হিকমানি মনে করেন চিতাগুলোর সুরক্ষার জন্য 'এখনও অনেক কিছু করা বাকি আছে।'
ওমানের বাইরের হাল
ওমানের বাইরে চিতাগুলোর অবস্থা বেশি অনিশ্চিত। আইইউসিএন-এর সূত্রানুসারে সৌদি আরবে শেষ যে চিতাটিকে দেখা গিয়েছিল সেটিকে ২০১৪ তে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল। এজন্য মনে করা হয় সেখানে প্রজননের মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি করার মতো চিতা আর অবশিষ্ট নেই।
আরবে স্থানীয় চিতার সংখ্যা বাড়াতে এবং অ্যারাবিয়ান লেপার্ড ফান্ড গঠন করতে দ্য রয়েল কমিশন ফর আল-উলা (আরসিইউ) ২৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি করেছে। আরসিইউ-য়ের পার্টনার প্যানথেরা সৌদি আরবের বন্য চিতার জরিপ করছে। ঘরবন্দি প্রজনন বা ক্যাপটিভ ব্রিডিং-য়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গত এপ্রিলে ১৬ টি বাচ্চা জন্মেছে সেখান থেকে।
ইয়েমেনে যুদ্ধ চলার কারণে বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ইয়েমেনে মৃত চিতার যে ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সেগুলোই অ্যারাবিয়ান চিতার ব্যাপারে জানার একমাত্র উপায়। একবার একটি ভিডিওতে জ্যান্ত চিতা দেখা গিয়েছিল। স্পালটন বলেন, 'ইয়েমেনে কোনো চিতা অবশিষ্ট আছে কিনা সে ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আমরা কিছুই জানি না।'
২০১৫ সালে আইইউসিএন কয়েকটি ইসরাইলি প্রজাতিকে সম্ভাব্য অ্যারাবিয়ান চিতার তালিকায় রেখেছে। ২০০৬ সালের একটি সমীক্ষায় আটটি চিতার কথা উল্লেখ করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে কোনো চিতার হদিস পাওয়া যায়নি। তবুও, ইসরাইলে চিতাকে এখন পর্যন্ত বিলুপ্ত প্রজাতির তকমা দেওয়া হয়নি।
বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক চিতার অবস্থান, প্রাপ্তি, বিলুপ্তি ইত্যাদি নিয়ে কর্তৃপক্ষ নতুন করে জরিপ পরিচালনা করছে। আল হিকমানি ওমানে চিতার ভবিষ্যত সুরক্ষা করতে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাচ্ছে। ইয়েমেন সীমান্তের পাশে দোফারে চিতার নতুন আরেকটি অভয়ারণ্য স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে ওমান।
হিকমানি সমমনাদের সাথে নিয়ে দেশের ভেতর আরো সংরক্ষণবাদী তৈরি করতে আগ্রহী। তিনি বলেন সংরক্ষিত এলাকার প্রহরীরা যথেষ্ট বিজ্ঞ তবে তাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কিছুটা অভাব আছে। চিতা নিয়ে গবেষণাকর্মকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে হিকমানি বৃত্তি এবং পেশাদারি প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনের পরিকল্পনা করছে।
স্পালটনের অভিমত অনুসারে ইকোটুরিজমের প্রসার ঘটলে স্থানীয় অধিবাসীদের কাজের ক্ষেত্র ও আয়ের উৎস প্রসারিত হবে। পর্যটিকদের জন্য সবচেয়ে মজাদায়ক বিষয় হবে স্বচক্ষে চিতার দেখা পাওয়া।
মূল কথা হল, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে আগের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে নতুনভাবে শুরু করা।
হিকমানির বক্তব্য, 'ইতিমধ্যে অনেক দেশীয় প্রাণীর প্রজাতি হারিয়ে গিয়েছে। আমরা চাই না চিতাও সেভাবে হারিয়ে যাক।'
সূত্র: সিএনএন