নেদারল্যান্ডের শিশুরা কেন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী?
গত এক দশক ধরে নিয়মিতভাবেই বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী বলে প্রমাণিত হয়ে আসছে নেদারল্যান্ডের শিশুরা। ইউনিসেফের সর্বশেষ প্রতিবেদনও জানাচ্ছে, নেদারল্যান্ডের শিশুদের মাঝেই ভালো থাকার অনুভূতি সবচেয়ে বেশি কাজ করে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থাটি ৪১টি উচ্চ-আয়ের দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করেছে যে সেসব দেশের শিশুরা মানসিক সুস্থতা, শারীরিক স্বাস্থ্য এবং অ্যাকাডেমিক ও সামাজিক উভয় ধরনের দক্ষতার দিক দিয়ে কেমন স্কোর করেছে।
সেখানে দেখা গেছে, ভালো থাকার তিনটি সূচক মিলিয়ে নেদারল্যান্ডের শিশুরা সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তাদের পরেই অবস্থান ডেনমার্ক ও নরওয়ের। অন্যদিকে চিলি, বুলগেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তালিকার একেবারে তলানিতে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি)-র ২০২০ সালের বেটার লাইফ ইনডেক্সেও দেখা গেছে, উপার্জন, শিক্ষা, আবাসন ও স্বাস্থ্য অবস্থাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ড গড়পড়তার চেয়ে ভালো স্কোর করেছে।
'দ্য ওয়ার্কিং প্যারেন্ট'স সারভাইভাল গাইড' বইয়ের লেখক আনিতা ক্লেয়ারের মতে, শিশুদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপর আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর প্রভাব অনুধাবন করা জরুরি। তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, কোনো শিশুর নির্দিষ্ট চাহিদাগুলো যদি পূরণ করা হয়, তবে তার সুখলাভের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর শিশুদেরই চাহিদা পূরণের হার সবচেয়ে বেশি।
ক্লেয়ার বলেন, প্যারেন্টিং বা সন্তান লালন-পালনের আত্মবিশ্বাসী রূপ হলো যেখানে বাবা-মা তাদের সন্তানকে যথেষ্ট ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু কিছু সুস্পষ্ট গণ্ডিও নির্ধারণ করে দেন। এ ধরনের প্যারেন্টিংই শিশুদের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে।
সেই সঙ্গে ক্লেয়ার এ কথাও যোগ করেন যে শিশুদের জন্য লজ্জা অনেক বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু ডাচ শিশুরা সৌভাগ্যবান যে তাদের বাবা-মা ও বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের সঙ্গে অকপটে এমন সব বিষয়আশয় নিয়ে কথা বলে, যেগুলো অন্য অধিকাংশ দেশেই ট্যাবু কিংবা অস্বস্তিকর বলে বিবেচিত হয়।
নেদারল্যান্ডে শিশুদের মতামতকেও বড়রা যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। অন্যান্য দেশে যেখানে শিশুরা মুখ খুলতে চাইলেই তাদেরকে 'ইঁচড়ে পাকা' বলে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, সেখানে ডাচ শিশুদেরকে প্রতিনিয়ত উৎসাহী করা হয় নিজেদের ভাবনার বহিঃপ্রকাশে। যখন থেকে ডাচ শিশুরা নিজেদের মতো করে অর্থপূর্ণ বাক্য সাজাতে পারে, তখন থেকেই বড়রা তাদের সব কথা মন দিয়ে শোনে, এবং আশানুরূপ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে আরেকটি ব্যাপারেও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে, ধনী দেশে জন্ম নিলেই যে সব শিশুর একটি সুন্দর শৈশব লাভ নিশ্চিত হবে, তা একদমই নয়।
"এমনকি উন্নত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অবস্থা সমৃদ্ধ দেশগুলোও ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার লক্ষ্য পূরণ থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে," ইউনিসেফ তাদের প্রতিবেদনে জানায়।
এ ধরনের পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠতে ইউনিসেফ উচ্চ-আয়ের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করে যে শিশুদের জীবনের উন্নতি কীভাবে ঘটানো সম্ভব, এবং সে অনুযায়ী যেন শিশুদের মানসিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে।
বন্ধুত্বের সারল্য
ক্লেয়ার বলেন, ডাচদের সুনাম রয়েছে "বৈচিত্র্যকে মূল্য দেওয়ার, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আচরণের।"
প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি মনে করেন, কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে বেশ ভালোভাবেই আঁচ করা যায়, দৈনন্দিন জীবনে শিশুদেরকে কতটা অ্যাকাডেমিক ও সামাজিক চাপ সামলাতে হয়।
"তাই আমার মনে হয়, কোনো শিশু যদি এমন একটি সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠে যেখানে প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে উদযাপন করা হয়, নিজেদের মতো করে জীবন সাজানোর সুযোগ থাকে, এবং প্রতি পদে পদে শিশুদের কাজের বিচার করা না হয়, তাহলে ওই শিশু তুলনামূলক বেশি ইতিবাচকভাবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে, খেলার মাঠেও ইতিবাচক থাকবে, এবং এতে করে উপকৃত হবে তার সুখের মাত্রা," তিনি বলেন।
ইউনিসেফের গবেষণা থেকে দেখা যায়, নেদারল্যান্ডের ১৫ বছর বয়সী ৮১ শতাংশ কিশোরই জানিয়েছে যে তাদের মনে হয় তারা খুব সহজেই কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৪১টি দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডেই এই হার সর্বাধিক।
প্রতিযোগিতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা
তাছাড়া আরো দেখা গেছে যে, দেশটির ১৫ বছর বয়সী যে কিশোররা স্কুলকে আপন মনে করে এবং স্কুলের প্রতি যাদের মনে ভয় কাজ করে না, জীবন নিয়ে তাদের মনে সন্তুষ্টি সবচেয়ে বেশি।
দক্ষতা বিকাশ সংস্থা গুড প্লে গাইডের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামান্ডা গামার জানান, নেদারল্যান্ডের স্কুল ব্যবস্থা 'নন-কম্পিটিটিভ', এবং সেখানে অ্যাকাডেমিক সাফল্যের চেয়ে শেখার ব্যাপারে শিশুদের মনে গভীর অনুরাগ গড়ে তোলাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
তিনি বাবা-মায়েদের উদ্দেশ্যে বলেন যে "পরীক্ষার ফলাফলই জীবনের সবকিছু নয়," এবং তাদের উচিত শিশুর মনের কৌতূহলগুলো মেটানোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
গামার বলেন, শিশুদের মানসিক সুস্থতায় দৃষ্টান্তস্বরূপ যে দেশগুলো, তাদের কাছ থেকে সকলেরই শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইউনিসেফের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা নরওয়ের মধ্যে একটি "একতাবদ্ধতার সংস্কৃতি" রয়েছে বলে মনে করেন গামার।
"অন্যকে সাহায্য করা আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী হতে পারে। তাই ভেবে দেখুন, কীভাবে আপনার পরিবার গোটা সমাজের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে।" তিনি আরো বলেন যে ভলান্টিয়ারিং হতে পারে একতার বোধ গড়ে তোলার একটি ভালো উপায়।
সামগ্রিক সুখ
বাবা-মায়ের সুখের উপরই সাধারণত নির্ভর করে শিশুদের সুখ-শান্তি। যে পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যে নিত্যদিন কলহ লেগে থাকে, সেসব পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু যে অল্প বয়স থেকেই নেতিবাচক মানসিকতার অধিকারী হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
কিন্তু নেদারল্যান্ডে কেবল শিশুরাই সুখী নয়, বরং সামগ্রিকভাবেই নেদারল্যান্ডের সব বয়সী মানুষ অনেক সুখী। প্রতিবছরই হ্যাপিনেস ইনডেক্সগুলোতে সেরার কাতারে থাকে নেদারল্যান্ড। সর্বশেষ ২০২০ সালেও বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ সুখী দেশ ছিল তারা। তাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল কেবল ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ড।
চারপাশে যদি সুখী মানুষদের আনাগোনা থাকে, পরিবারেও বিরাজ করে শান্তিপূর্ণ আবহ, তবে তা নিঃসন্দেহে শিশুদের সাহায্য করে মানসিকভাবে স্থিত থাকতে। নেদারল্যান্ডের শিশুদের বেলায়ও তেমনটিই হয়েছে।
আলাদা করে বলা যায় ডাচ মায়েদের সুখের ব্যাপারেও। জেনে অবাক হবেন, 'ডাচ উইমেন ডোন্ট গেট ডিপ্রেসড' নামে একটি বইও রয়েছে। যেনতেন ব্যক্তি লেখেননি সেই বই। লিখেছেন ডাচ মনস্তত্ত্ববিদ ও সাংবাদিক এলেন ডি ব্রুইনা।
এলেনের মতে, "ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নেদারল্যান্ডের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারে। এছাড়াও পারে নিজেদের ধর্ম, যৌনতাকে আলিঙ্গন করতে। আমরা যা খুশি তাই বলারও সুযোগ পাই। সবমিলিয়ে নেদারল্যান্ড একটি খুবই স্বাধীন দেশ।"
আর এই স্বাধীন দেশের নারীদের প্রায়োরিটি লিস্টে শারীরিক সৌন্দর্য, আকর্ষণীয়তা বা আতিথেয়তার ঠাঁই নেই। ডি ব্রুইনা সাধারণীকরণের মাধ্যমে ডাচ নারীদের ব্যাপারে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ জানান। যেমন তারা জানে না কীভাবে পোশাক পরতে হবে (কারণ তারা প্রায় সব জায়গাতেই বিকিনি পরে হাজির হয়), অসময়ে বাসায় হাজির হওয়া অতিথিকে তারা সরাসরি ফেরত পাঠাতে পারে, স্বামী বা সঙ্গীকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এসব কারণে তারা প্রায় সবসময়ই সুখী থাকে।
তবে ডাচ নারীদের সুখী থাকার প্রধানতম কারণ সম্ভবত এই যে, তারা একদম পারফেক্ট একটি ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স পেয়েছে। ওইসিডি অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ডাচ মায়েরাই সবচেয়ে বেশি পার্ট টাইম কাজ করে। তাদেরকে সপ্তাহে কাজ করতে হয় মাত্র ২৫ ঘণ্টা। ফলে সহজেই তারা কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত একসঙ্গে সামলাতে পারে।
এভাবে সুখী মায়েদের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা ডাচ শিশুদের মনস্তত্ত্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, ফলে তারা মানসিকভাবে অধিকাংশ সময়ই চাঙ্গা ও উৎফুল্ল থাকতে পারে।
বাবার সান্নিধ্য
পুরুষতান্ত্রিক দেশগুলোতে, যেখানে বাবারা বাইরে কাজ করে আর মায়েরা ঘরে থাকে, সেখানে শিশুরা তাদের বাবাকে কাছে পায় না বললেই চলে। তাই মায়ের সঙ্গে তাদের যতটা অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে, বাবাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে না তার ছিটেফোঁটাও।
এদিকে উন্নত বিশ্বে, লিঙ্গবৈষম্যহীন দেশগুলোতে দেখা যায় নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান পদচারণা কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু বাড়িতে তারা কেউই সন্তানকে খুব বেশি সময় দিতে পারে না। এজন্য বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে শিশুরা একা একা বেড়ে ওঠে, সঠিক সামাজিকীকরণের অভিজ্ঞতা ছাড়াই।
তবে যেমনটি আগেই বলেছি, ডাচ শিশুদেরকে তাদের মা যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিতে পারে। একই কথা প্রযোজ্য বাবাদের ক্ষেত্রেও। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল 'ওয়ার্কিং ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি' শীর্ষক একটি নিবন্ধ, যেখানে উঠে আসে ডাচদের পার্ট-টাইম কাজের সংস্কৃতি।
১৯৯৬ সালে ডাচ সরকার সেদেশের পার্ট-টাইম চাকরিজীবীদের ফুল-টাইম চাকরিজীবীর সমান সম্মান দেয়। এতে করে পুরুষ চাকরিজীবীদের পক্ষেও সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয় সারাদিন কাজে ডুবে থাকার বদলে পরিবারকে সময় দেওয়ার।
বর্তমানে অনেক ডাচ পুরুষই সপ্তাহে চারদিনেই শেষ করে ফেলে তাদের ফুল-টাইম চাকরি, এবং পুরো একটি দিন বরাদ্দ রাখে তাদের সন্তানদের জন্য। ওই দিনটিকে বলা হয় 'ড্যাডি ডে'। এর বাইরে সপ্তাহে দুইদিন নিয়মিত ছুটি তো রয়েছেই। এছাড়া প্রতি তিনজন ডাচ পুরুষের মধ্যে একজন পার্ট-টাইম কাজ করে। এর ফলে তারা অর্থোপার্জনের পাশাপাশি প্যারেন্টিংকে আরো সিরিয়াসলি নিতে পারে, এবং সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রতিটি অধ্যায়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে।
- সূত্র: সিএনবিসি