ডাচরা যেভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা জাতি হয়ে উঠেছে
একটি দেশ বা অঞ্চলের মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা চ্যালেঞ্জিং। কারণ স্বাস্থ্যের সূচকগুলোর ধারাবাহিকভাবে সংগৃহীত তথ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আমাদের সাম্প্রতিক এই গবেষণায় একটি দেশের বাসিন্দাদের সুস্বাস্থ্য এবং শারিরীক উচ্চতার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে উচ্চতা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। ১৮০০ সাল অবধি ইউরোপের গড় উচ্চতা ১৬৫ সেন্টিমিটার থেকে ১৭০ সেন্টিমিটারের মধ্যে ওঠানামা করত। তবে গত ২০০ বছরে উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বব্যাপীই মানুষের উচ্চতা বেড়েছে, তবে বিশেষত ইউরোপে এটি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।
অনেক ইউরোপীয় দেশে গড় উচ্চতা ১৫ সেন্টিমিটারেরও বেশি বেড়েছে এবং নেদারল্যান্ডসে এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
১৮১০ সালের দিকে ডাচদের গড় উচ্চতা ছিল ১৬৬ সেন্টিমিটার, বর্তমানে যা ১৮৪ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ, মাত্র দুই শতাব্দীতে তাদের গড় উচ্চতা ১৮ সেন্টিমিটার বেড়েছে। ডাচ পুরুষরা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা।
যদিও নিঃসন্দেহে মানুষের উচ্চতা নির্ধারণে জেনেটিক্স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে পুরো জনসংখ্যার মধ্যে এই বিশাল পরিবর্তনটি কেবল বিবর্তন দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না, যদি তাই হতো তবে আরও অনেক আগে থেকেই মানুষের উচ্চতার পরিবর্তন শুরু হতো।
তবে গত ২০০ বছরে বিশ্বের বেশিরভাগ অংশের মতো নেদারল্যান্ডসও মৃত্যুহার হ্রাস, সংক্রামক রোগ হ্রাস, পুষ্টিকর খাদ্যের বিপুল সরবরাহসহ জীবনযাত্রার মানের সব ক্ষেত্রে বিশাল উন্নতি হয়েছে।
ডাচদের গড় উচ্চতা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তাই প্রাচুর্যময় পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যকর ও লম্বা জনসংখ্যার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সম্পর্ক প্রকাশ করে।
উচ্চতা, স্বাস্থ্য এবং বিকাশ
শারিরীক উচ্চতা এবং স্বাস্থ্য বিকাশে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রভাব থাকে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পুষ্টি। উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সুস্থ থাকার জন্য মানুষকে খাদ্য দিয়ে তার দেহকে সক্রিয় রাখতে হয়।
তবে এই বৃদ্ধির হার বেশ কিছু কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং উচ্চতা বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে। যেমন: অসুস্থতা, স্ট্রেস এবং কঠোর শারিরীক পরিশ্রম প্রভৃতি।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯ শতকে নেদারল্যান্ডসের মানুষদের দীর্ঘস্থায়ী বা বার বার রোগাক্রান্ত হওয়া এবং ডাচ প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চতা কমে যাওয়ার মধ্যে সম্পর্ক ছিল।
বর্তমানে দীর্ঘস্থায়ী রোগ কমে যাওয়া এখানকার মানুষের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ সম্ভবত সুস্থ শরীরে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে।
এছাড়া বাবা-মায়ের, বিশেষত মায়ের মৃত্যুর কারণেও সন্তানের উচ্চতা না বাড়ায় প্রভাব ফেলত। কারণ খুব ছোট শিশুরা পুষ্টির জন্য তাদের মায়ের ওপর নির্ভরশীল। তবে বড় শিশুদের ক্ষেত্রেও এটি সত্য ছিল। প্রাথমিক যত্ন নেওয়ার মানুষকে হারানোর গভীর চাপ তাদের উচ্চতা বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতো।
মজার ব্যাপার হলো, যদিও মাকে হারানো নেদারল্যান্ডস এবং অন্যান্য স্থানের শিশুদের উচ্চতা হ্রাসে প্রভাব ফেলে; তবে বাবাকে হারানোয় এই ধরনের প্রভাব দেখা যায় না। সম্ভবত এই বয়সের শিশুদের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে লিঙ্গগতভাবে বাবা-মায়ের ভিন্ন ভূমিকার কারণে এমনটা ঘটে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, উচ্চতাকে একজন মানুষের শারিরীক বিকাশের সময় যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে তার গুণমান ও পরিমাণের প্রতিফলন এবং জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধিকালের শেষ পর্যন্ত বিকাশকে ব্যাহত করে এধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
যৌবনে উচ্চতা এবং স্বাস্থ্য
প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্য পরিমাপের ক্ষেত্রে উচ্চতা বিষয়টি আরও জটিল। বর্তমানে দেখা যায়, গড় উচ্চতার চেয়ে বেশি লম্বা মানুষের, বিশেষত পুরুষদের সামগ্রিকভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি কম। তবে অতিরিক্ত লম্বা মানুষের (১৯০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি লম্বা) আবার মৃত্যুর ঝুঁকি কিছুটা বেশি। এর কারণ মূলত তাদের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে।
বিষয়টি শরীরের ভরের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। লম্বা দেহে বেশি কোষ এবং কোষ বিভাজন থাকে, যার অর্থ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়া, লম্বা মানুষদের বেশি ক্যালোরি খাওয়ার প্রবণতা থাকে, এটিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
ঐতিহাসিক (অর্থাৎ প্রাক-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) জনসংখ্যার দিকে তাকালে আবার এই বিষয়গুলো আরও জটিলতা সৃষ্টি করে।সেসময় লম্বা মানুষদের (পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই) অল্প বয়সে মারা যাওয়ার প্রবণতা ছিল।
তাদের মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কারণ সম্ভবত লম্বা মানুষের তুলনায় খাটো মানুষের কম ক্যালোরি প্রয়োজন। খাদ্য ঘাটতির সময়ে (অতীতে যা প্রায়ই হতো) খাটো মানুষেরা তাই অপুষ্টির কম ঝুঁকিতে থাকতো।
এই দুটি কারণের বলা যায়, সেসময় লম্বা মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি ছিল।
তাছাড়া ঐতিহাসিক মানুষদের মধ্যে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারও বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল।
বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে লম্বা হওয়ার গল্প
যদিও আমরা আমাদের গবেষণায় অতীতের গবেষণা থেকে শুধু উচ্চতার প্রাসঙ্গিকতার ওপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছি, তবে বলতেই হবে বর্তমানের স্বাস্থ্যসেবার ওপর অতীতের এসব গবেষণার উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের স্টান্টিং বা স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধির বক্ররেখা হিসেবে বিবেচিত একটি পদ্ধতির সাহায্যে কোনো শিশু শারিরীক বিকাশের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে কি না সে সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে।
এই পদ্ধতিটি একটি দেশ বা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা নির্ণয় করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
তবে নেদারল্যান্ডসের তরুণ-তরুণীরা বর্তমানে তাদের বাবা-মায়ের চেয়ে কম উচ্চতাসম্পন্ন। অর্থাৎ, কোনো কারণে ফের আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা এই মানুষদের উচ্চতা কমে যাচ্ছে। তবে এর কারণ এখনও স্পষ্ট নয়।
এটি বেশ কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে: খাবারের গুণমান কি কমে গেছে? শিশুদের স্থূলতা কি তাদের উচ্চতা বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে?
দেশের জনগণের উচ্চতা কেন বাড়ছে বা কমে যাচ্ছে তা নির্ণয় করতে পারলে সহজই একটি জাতির শারিরীক স্বাস্থ্য বোঝা যেতে পারে।
লেখিকা ক্রিস্টিনা থম্পসন ওয়াগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলখ অ্যান্ড সোসাইটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।