বগুড়ার দই: ইংল্যান্ডের রানীও খেয়েছেন!
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/01/29/untitled-1.jpg)
পৃথিবীর অনেক জায়গার মানুষই দই খেতে পছন্দ করে। আর বাঙালি তো দই বলতে পাগল। মিষ্টি-টক দুই রকম দই-ই খায়। ভারতবর্ষর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা মানে ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশে মিষ্টি দই পাওয়া যায়। বাংলাদেশে দইয়ের জন্য বিশেষ নাম করেছে ফরিদপুরের বাঘাট আর মাগুরার খামারপাড়া। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ আদর নবদ্বীপের লাল দই। এতক্ষণ পরেও বগুড়ার দইয়ের নাম না করায় নিশ্চয় অনেকে ফুসছেন। আসলে রসিয়ে রসিয়ে বলব বলেই হচ্ছে দেরী বলতে এ ভুবনমোহিনী দইয়ের গল্প।
রাজা তো বটেই, রানীও খেয়েছেন
গত শতকের ষাদের দশকের কথা। আইয়ুব খান তখন পাকিস্তানের শাসক। স্বৈরশাসক হলে কি হবে খাবারের কদর বুঝতেন। বাঙালিকে না ভালোবাসলেও বাঙালির দইকে ভালোবাসতেন। বগুড়ায় গিয়ে তিনি দই খেয়েছেন। পরে বন্ধুত্ব পাতাতে পৃথিবীর বাঘা বাঘা লোকদের সেই দই খাইয়েছেন। লোকে বলে, তিনি ভালোবাসা জানাতে এ দই পাঠিয়েছেন মারকিন মুলুকে তার পেয়ারের দোস্তদের। ব্রিটিশদেরও মজিয়েছেন এ দইয়ের প্রেমে। আরো জানা যায়, গেল ষাটের দশকে বগুড়ার দই ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও খেয়েছেন।
আরো কথা বগুড়া দইয়ের
মিষ্টি তো বটেই সাদা টক দইও তৈরি হয়ে থাকে বগুড়ায়। তবে মিষ্টি দইটাই নাম করেছে আর দামও কেড়েছে অনেকে। বয়স্ক যারা তারা বলেন, এখানকার দইয়ের ইতিহাস ধরে টানলে ২০০ বছরের আগের শেকড় উঠে আসবে। শেরপুর বগুড়ার এক উপজেলা। ২০ কিলোমিটার দূরে সদর থেকে। সেখানকার ঘোষদের নামই আসে আগে । ঘটনা ১৯৩৮ সালে। বগুড়ার নবাব দাওয়াত দিয়েছিলেন ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসনকে। কী খাওয়াবেন, কী খাওয়াবেন-পোলাও, রোস্ট, কাবাব, কাটলেট, চপ তো থাকছেই। তবে এগুলো সাবেব নিত্যি দাওয়াতেই খান, বিশেষ তিনি আজ খাবেন-দই। কাচের পাত্রে বগুড়ার দই। আর তা খেয়ে তিনি এতোই মুগ্ধ হলেন যে ইংল্যান্ডে খালা-খালু, শালা-শালীদের কাছে বগুড়ার দই পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
সরার দইয়ের প্রথম যিনি
শোনা যায় গৌর গোপাল ঘোষের নাম। সরায় দই তিনিই প্রথম পেতেছিলেন বগুড়ায়। তবে কেউ কেউ বলেন তাঁর পদবী ঘোষ নয়, পাল। দেশভাগের কালে ভারতে থেকে নাকি চলে এসেছিলেন বগুড়ার শেরপুরে। সেখানকার ঘোষেরা তাঁর আত্মীয় ছিল। পরে বগুড়ার নবাব পরিবারে তিনি সই সরবরাহ করতে থাকেন। নবাব মোহাম্মদ আলীর পরিবার তাকে ডেকে নিয়ে প্যালেসের আমবাগানের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। গৌর গোপালের ফর্মুলায় তৈরি করা দইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। এরপর অনেকেই সেই
ফর্মুলা মেনে দই তৈরি করতে থাকেন। উল্লেখ্য সরার দইয়ে সরের পরিমাণ বেশি থাকে। শেরপুরের দই নিয়ে প্রবাদ আছে, দই মিষ্টির ক্ষিরসা, রাজা বাদশা শেরশাহ, মসজিদ মন্দির মূর্চাঘর, এসব মিলেই শেরপুর।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/01/29/fb_img_1561539381984.jpg)
ভারত উঠে পড়ে লেগেছে
বগুড়ার দইয়ের স্বাদ পেতে এখন উঠে পড়ে লেগেছে ভারত। গেলবার জলপাইগুড়ি জেলার চেম্বার কর্মকর্তাদের মধ্যে বগুড়ার দই নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগে। তখন সেখানে বাণিজ্যমেলা হচ্ছিল। বগুড়ার দই তখন এতোই নজর কেড়েছিল যে ১০ মেট্রিক টন মানে ৬শ গ্রাম ওজনের ১৭ হাজার সরা দই সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু এ যে দক্ষযজ্ঞ। মেটানো যায়নি তাদের আবদার। তারপরের ডিসেম্বরে অবশ্য জলপাইগুড়িতেই নরথ বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত বাণিজ্যমেলায় ৫শ কেজি দই পাঠানো হয়েছিল।
কেন বিশেষ
দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত সাজেদুর আবেদীন শান্তর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বগুড়ার দইয়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরন করা হয়। মান নিয়ন্ত্রণেও তারা যত্নবান। বগুড়া শহরে দই উৎপাদন শুরু হয় বগুড়ার নওয়াব আলতাফ আলী চৌধুরীর পৃষঠপোষকতায়। শেরপুর ও সোনাতলার নামাজখালীর দই-ই নাম করেছে বেশি। দুধ, চিনি আর মাটির কাপ বা সরা ব্যবহৃত হয় দই তৈরিতি। একটি বড় পাত্রে ছয় ঘণ্টা দুধ ও চিনি জ্বাল দেওয়া হয়। পরে লালচে বর্ণ ধারণ করলে তা মাটির সরা বা কাপে ঢেলে ঢেকে রাখতে হয়। এরপর সারারাত ঢাকা থাকার পর সকালে পাওয়া যায় দই।
১৬ মণ দুধে প্রায় ৪৫০ সরা দই বানানো সম্ভব বলে জানান কারিগররা। নামাজখালীর কারিগর পরিতোষ। ৩৫ বছর ধরে দইয়ের ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, 'চাহিদা অনেক আমাদের দইয়ের। তবে দুধ ও চিনির দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমরা কিন্তু দইয়ের দাম সেভাবে বাড়াইনি। করোনাকালেও আমরা ভালোই ব্যবসা করেছি। আমাদের গ্রামে আগে ৪০০-৫০০ পরিবার এ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। এখন কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করেছে।'
বগুড়ার দইয়ের দাম পাত্রভেদে বিভিন্ন। ২০ গ্রামের কাপ দইয়ের দাম ২০ টাকা। ৭০০ গ্রামের মাঝারি সরা ১৪০ টাকা, মাঝারি হাড়ার ৮০০ গ্রাম দইয়ের দাম ১৮০ টাকা এবং সবচেয়ে বড় আকারের ১ কেজির সরার দাম ২২০ টাকা। উল্লেখ্য ওই দাম ২০২১ সালের ডিসেম্বরের। এর মধ্যে কিছু হেরফের হয়ে থাকতে পারে।
দইয়ের প্রকারভেদ
মিষ্টি দই: দই বলতে মিষ্টি দইই বোঝায়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়।
সাদা দই: এতে কোনো মিষ্টি ব্যবহার করা হয় না। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের জন্য এই দই। এটি পানসে হয় সাধারণত।
টক দই : অনেকদাই সাদা দইয়ের মতো।
ঘোলের দই: শুধু মাত্র ঘোল খাওয়ার জন্য এই দই। তবে মিষ্টি দই দিয়েও ভালো ঘোল হয়।
শাহী দই: মিষ্টি দইয়ের আধুনিক সংস্করণ। স্পেশাল মিষ্টি দই হলো শাহী দই। সবগুলোর মধ্যে এটিই সুস্বাদু।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/01/29/f247827f11d8a7a58cd45634cb667836-61b4851303900.jpg)
পাতিল ও শোরুম
১৯৬৮ সালে গৌরগোপাল আম বাগান ছেড়ে চেলো পাড়ায় গিয়ে বসত নেন। ভাই সুরেন ঘোষের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন নতুন কারখানা। সেখান থেকে দই পাঠাতে থাকেন দেশের নানা জায়গায়। তারাই কিন্তু প্রথম ছোট ছোট পাতিলে দই বিক্রি শুরু করেন। শোরুম বানিয়ে দই বিক্রির কৃতিত্বও তাদেরই দিতে হবে। বগুড়াতে এখন ১০০টি দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৩০ লক্ষ টাকার দই বিক্রি হয়। বগুড়ায় ভালো মানের দই দোকান হলো আকবরিয়া, শ্যামলি, শাহী দইঘর, মহরম আলী দইঘর, চিনিপাতা, দই বাজার ইত্যাদি। শেরপুরেও আছে ৫০টির মতো দোকান। নাম- সাউদিয়া, শম্পা, চৈতী, রিপন ইত্যাদি।
বিশেষ সুখবর
ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তানেও বগুড়ার দইয়ের ব্যাপক চাহিদা।