নতুন ফান্ড ট্রান্সফার সফ্টওয়্যার নগদ অর্থ পেতে দরিদ্রদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটাবে
দেশে তৈরি একটি ডিজিটাল ফান্ড ট্রান্সফার প্ল্যাটফর্মের সফলতার পর, আরও কম সময়ে সাশ্রয়ীভাবে লেনদেন করতে আরও বড় পরিসরের একটি ডেটা প্রসেসিং সফটওয়্যার তৈরির কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ কাজে নিয়োজিত আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নয় সদস্যের একটি দল। আশা করা হচ্ছে, নতুন এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ঘণ্টায় ৪৬ লাখ ইএফটি লেনদেন (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) সম্ভব হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই সফলতার সঙ্গে সাধারণ ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে সফটওয়্যারটি পরিচালনা করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে সফটওয়্যারটি পুরোদমে চালু হবে।
সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা, কোর ব্যাংকিং সেবা এবং আন্তঃব্যাংক চেক লেনদেনের ক্ষেত্রে এই সফটওয়্যার যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চলেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
তাদের মতে, কাগজভিত্তিক ম্যানুয়াল লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ বিতরণে সরকারকে মোট তহবিলের প্রায় ২৫ শতাংশই পরিচালনা ব্যয় হিসেবে খরচ করতে হতো। কেননা লেনদেন প্রক্রিয়ায় সরকার এবং ব্যাংকগুলোর উভয় পক্ষের অসংখ্য কর্মচারী মোতায়েন করার প্রয়োজন পড়ত।
ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার কারণে উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে এই ব্যয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা সমসময়ই আরও ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় যেতে চাই। নতুন সফটওয়্যারের মাধ্যমে লেনদেন বাস্তবায়িত হলে স্বল্প সময়েই জন তহবিল বিতরণ করা সম্ভব হবে, যার ফলে রাতারাতি জনশক্তির প্রয়োজন কমবে। এর ফলে তহবিল বিতরণও আগের চেয়ে আরও সাশ্রয়ী হবে।"
সফটওয়্যারের নিয়ে কাজ করা দলটি এর আগেও সাফল্যের সঙ্গে গভর্নমেন্ট ইট্রান্সেকশন প্রসেসিং হাব (গেটপিএইচ) নামে একটি সফটওয়্যার নির্ভর তহবিল ব্যবস্থাপনা প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আসে। সফটওয়্যারটি ঘণ্টায় ছয় লাখ লেনদেন সম্পন্ন করতে পারে। এর আগে, কোর ব্যাংকিং সলিউশন ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিনে এক লাখের কিছু বেশি লেনদেন সম্পন্ন করতে পারত।
নতুন ইএফটি প্ল্যাটফর্মের প্রশংসা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, "এই পদক্ষেপটি বিশাল। আমরা ইতোমধ্যেই গেটপিএইচ সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ছয় লাখ লেনদেন নিষ্পত্তি করতে সক্ষম। এখন আমরা নিকাশের মাধ্যমে ঘণ্টায় ৪৬ লাখের বেশি লেনদেন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছি। সরকারি ব্যয়ের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি।"
সরকারের লক্ষ্য সকল সরকারি কর্মচারীর বেতন, কেনাকাটার ব্যয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, উন্নয়ন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অর্থায়ন, এবং সকল এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন ডিজিটালি বিতরণ করা। নতুন প্ল্যাটফর্ম বাস্তবায়িত হলে লক্ষ্যপূরণে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে সরকারকে প্রতি মাসে দুই কোটির বেশি ইএফটি লেনদেনের করতে হয় বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য মাসে পাঁচ কোটি ইএফটি লেনদেন সক্ষমতা অর্জন করা।
বড় একটি সাফল্য:
সরকারের সমন্বিত আর্থিক লেনদেন পরিকল্পনা সফল করতে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সফটওয়্যার নির্ভর ফান্ড ট্রান্সফার প্ল্যাটফর্ম গেটপিএইচ চালু করে।
২০২১ সালে সরকারি কর্মচারীদের বেতন, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাতা ও প্রণোদনা, শিক্ষার্থীদের বৃত্তিসহ ব্যক্তিকেন্দ্রিক যাবতীয় সরকারি অর্থায়ন ডিজিটালি সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছে এই সফটওয়্যার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ২ কোটি ৬৭ লাখ সুবিধাভোগীকে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিতরণ করা হয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (বিইএফটিএন)-এর মাধ্যমে সীমিত পরিসরে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেওয়া শুরু করে। তার আগ-অবধি ম্যানুয়াল ব্যবস্থায় বেতন পরিশোধে তিন থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত সময় লাগত।
প্রথম বছরে সরকারি তহবিল সংক্রান্ত ৩২ হাজার ৪৮৯ ইউনিট ডেটা প্রসেস করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, গেল বছর যার পরিমাণ ছিল ১৩.৩৯ কোটি। অর্থাৎ, ৩৫০ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তহবিল স্থানান্তরে ইলেকট্রনিক সিস্টেম ইএফটিএন (EFTN) এর মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন হয়।
এটি সুবিধাভোগীদের এক দিনের মধ্যে তহবিল পেতে সহায়তা করে; কাগজ-কলমের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে যাতে আগে ৩-৬ মাস সময় লাগত। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি তহবিল স্থানান্তরকে খরচ-সাশ্রয়ী করার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় তহবিল বিতরণ করার সময় দুর্নীতি দূর করতে সহায়তা করেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে, সরকার ১৬টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, স্তন্যদানকারী মা, মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা, প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভাতা প্রদানের আওতায় ১৩ হাজার ১২৬ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। সরকার যদি এই লেনদেনগুলি ম্যানুয়াল ব্যবস্থায় সম্পন্ন করতে চাইতো- তাহলে এ তহবিলের ২৫ শতাংশ বা প্রায় ৩ হাজার ২৮২ কোটি টাকা পরিচালনা খরচ হিসাবে ব্যয় করতে হতো।
ম্যানুয়াল প্রক্রিয়া সত্যিই ছিল সময়সাপেক্ষ। এতে জনশক্তির একটি বড় সম্পৃক্ততার প্রয়োজন ছিল। কারণ এই প্রক্রিয়ায় তহবিল বিতরণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন।
এখন তহবিল স্থানান্তরের জন্য কোনও খরচের প্রয়োজন নেই- কারণ পেমেন্টগুলি ব্যাংকিং চ্যানেলগুলির মাধ্যমেই হয়। তবে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে লেনদেন করা হলে সরকার ০.৭০ শতাংশ খরচ হিসেবে গণনা করে।
গত ডিসেম্বরে গেটপিএইচ- এর জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, "এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি মোট তহবিলের ২৫ শতাংশের বেশি সাশ্রয় করে, আগে যা পরিচালনা খরচ হিসাবে ব্যয় হতো। সুতরাং, অর্থ এবং সময়ের বিবেচনায় সফ্টওয়্যারটি সরকারি খরচ কমাতে একটি বড় ভূমিকা রাখছে।"
"আগে জনে জনে সরকারি ভাতা বিতরণে তিন-ছয় মাস সময় লাগত, কিন্তু এখন তা শুধুমাত্র একটি ক্লিকের বিষয়,"- যোগ করেন তিনি।
এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা তহবিল আত্মসাৎ করার জন্য সুবিধাভোগীদের তথ্য-উপাত্তে হেরফের করেছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কাছ থেকে তহবিল পাওয়ার পর, নতুন প্ল্যাটফর্মটি অ্যাকাউন্টধারীদের কাছে সরাসরি অর্থ স্থানান্তর করে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
সহায়তা পাওয়ার জন্য সকল সুবিধাভোগীকে এখন ব্যাংক বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) প্রদানকারীদের কাছে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। অ্যাকাউন্টের তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষিত থাকে। নতুন প্ল্যাটফর্মটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কাছ থেকে তহবিল পাওয়ার পরে সরাসরি অ্যাকাউন্টধারীদের কাছে অর্থ স্থানান্তর করে।
সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্ল্যাটফর্মে তহবিলের স্থানান্তর অত্যন্ত সুরক্ষিত কারণ লেনদেন-সম্পর্কিত ডেটা একটি এনক্রিপ্টেড মডেল অনুসরণ করে পাঠানো হয়।
বিএফটিএন- এর সংস্কার:
নতুন সফ্টওয়্যারটির নাম "নিকাশ" রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (বিইএফটিএন) সফ্টওয়্যার সংস্কার করে তৈরি করা হচ্ছে।
গেটপিএইচ -এর বিশাল সাফল্য দেখে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিইএফটিএন সংস্কারের জন্য এটির তত্ত্বাবধায়ক সংস্থাকে আগ্রহের কথা জানায়। কিন্তু, কোম্পানিটি ১২ লাখ ডলার সংস্কার বিল দাবি করলে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিকল্প উৎসমুখী হতে হয়।
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব প্রকৌশলীরাই সংস্কারের চ্যালেঞ্জকে একটি সুযোগ হিসেবে নেন, অবশেষে তারা সফলতার পথেই রয়েছেন।
রৌপ্যপদক জয়ী টিম:
গেটপিএইচ তৈরি করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পাঁচ সদস্যের টিম। দলের অধিকাংশ সদস্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে কম্পিউটার সেলে কর্মরত, মূলত তারাই "নিকাশ" ডেভেলপে জড়িত রয়েছেন। গত মাসে তাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মচারী পুরস্কার-২০১৯- এ ভূষিত করা হয়েছিল।
এই টিমের সদস্যরা হলেন- সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট মোহাম্মদ রাহাত উদ্দিন, সিনিয়র প্রোগ্রামার আবু সাদাত মোহাম্মদ ইয়াসিন, প্রোগ্রামার মোঃ মাসুদ রানা, মোঃ নুরুল ইসলাম মোল্লা এবং যুগ্ম পরিচালক একেএম মুখলেছুর রহমান।