এখনও ঢাকার চিকেন পেটিস ও বাটার কেকের জন্য ডিসেন্ট সেরা!
ঢাকায় পেস্ট্রির ক্ষেত্রে অনেক কিছুই প্রথম বা নতুনভাবে ক্রেতাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল পুরান ঢাকার ডিসেন্ট পেস্ট্রি শপ। কেক-পেস্ট্রির জন্য এই বেকারির নাম সুবিদিত। বহুদিন ধরেই, ঢাকার আশেপাশে বিশেষ করে পুরান ঢাকাবাসীর কাছে কেক, মিষ্টি, পেস্ট্রির জন্য বিশেষ খ্যাতি রয়েছে 'ডিসেন্ট পেস্ট্রি শপ'-য়ের। জন্মদিন, পার্টি বা গায়ে হলুদে ডিসেন্টের কেক-পেস্ট্রি ছাড়া পুরান ঢাকাবাসীর কোনো অনুষ্ঠান এখনও কল্পনাই করা যায় না। এখানকার অনেক ব্যবসায়িক অনুষ্ঠান, প্রোমোশনাল সেরেমনিতেও আনা হয় ডিসেন্টের কেক।
অনেকের কাছে ডিসেন্টের নাম শুনে একদিন পুরান ঢাকার অসংখ্য অলি-গলি হেঁটে যখন পেস্ট্রি খেতে ডিসেন্টের দোকানে ঢুকলাম, মানুষের ভিড় দেখেই বুঝে গেলাম, ডিসেন্টের জনপ্রিয়তা নিয়ে বানিয়ে কিছু বলা হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ খাওয়ায় ব্যস্ত, নয়তো খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে।
দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়ে কাচের সেল্ফে সাজিয়ে রাখা হরেক রকমের বাহারি স্ন্যাকস আইটেম, সঙ্গে কেক ও মিষ্টি। সাজিয়ে রাখা আইটেমগুলোর পাশেই লিখে রাখা হয়েছে প্রতিটির মূল্য। দোকানের উপরের দেয়ালে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম তারা বেশ বড় করে লিখে রেখেছে কেকের ওপর ছবি প্রিন্ট অর্ডার নেওয়া হয়। এতো দারুণ অভিনব! দোকানের এক কর্মী জানান, আগেও তাদের এই প্রিন্ট করা ছবি কেক সার্ভিসটি ছিল, কিন্তু টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে কিছুদিন বন্ধ ছিল। আবার তারা এটি চালু করেছেন তাই এতো ঘটা করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া।
ডিসেন্ট পেস্ট্রির পথচলা যেভাবে
ডিসেন্ট পেস্ট্রি শপের তিন দশক পূর্ণ হতে চলেছে। ১৯৯২ সালে ঢাকায় প্রথম বাটারের কেকের প্রচলন তারাই করেন এবং এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। এখনো তারা তাদের সেই বিশেষত্ব ধরে রেখেছে। সিঙ্গাপুর থেকে আনা বাটার থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কেক ও পেস্ট্রি।
নব্বইয়ের দশকে জাকির হোসেনের হাত ধরে এটি যাত্রা শুরু করে। তিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন; ব্যবসার পরিধি বাড়াতে এখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছে। ঢাকায় বর্তমানে তাদের ১২টি সক্রিয় শাখা চালু রয়েছে।
কিভাবে আর কী কারণে 'ডিসেন্ট' নামটি দেওয়া হলো! তাদের সর্বাধিক বিক্রিত মাশরুম ও দুধের তৈরি বিশেষ ক্রিমি পেটিস খেতে খেতে কথাটা মাথায় আসলো। তাই পেস্ট্রি শপের অপারেশন ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা মোঃ হোসেনের কাছে জানতে চাইলাম। তিনি জানান তাদের প্রতিষ্ঠানের নামের পেছনের গল্পটি।
মোঃ হোসেন বলেন, "আমাদের প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং বর্তমানে যিনি চেয়ারম্যান তার চিন্তা ছিল শরীয়াহ মেনে সব খাবার প্রস্তুত হবে অর্থাৎ 'ডিসেন্টে কোন ইনডিসেন্ট কিছু হবে না' সেখান থেকেই মূলত এই নাম দেওয়া।"
জানালেন, "খাবারের জন্য আমরা যে মুরগীগুলো বাজার থেকে কিনে আনি তা মেশিনে ড্রেসিং করাই না। কাজটি সম্পূর্ণ হাতে করা হয় এবং এই কাজটি করার জন্য আমাদের আলাদা কর্মী আছে।"
মোঃ হোসেনের সাথে কথা বলে আরও জানা গেল, তাদের এখানে করপোরেট অর্ডার বেশি হয়ে থাকে। বিভিন্ন অফিস, আদালত ও জন্মদিন পার্টির অনুষ্ঠানের জন্য তাদের কাছে অনেক অর্ডার এসে থাকে। একরকম বিজয়ীর মতোই নিজেদের ব্যবসায় সাফল্যের কথা বলে গেলেন ম্যানেজার হোসেন।
"আমরাই বাজারে সেরা এটা নিয়ে সংশয় নেই। দীর্ঘ ১০ বছর বঙ্গভবন থেকে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ও এইরকম গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে আমাদের কাছে চিকেন পেটিস, আফলাতুন মিষ্টি, পেস্ট্রি, কাচাগোল্লার অর্ডার এসেছে- এটা আমাদের বড় অর্জন বলা যায়।"
ডিসেন্ট পেস্ট্রি শপে খেতে গেলে
এখানে আপনি কেক, বিস্কুট, রুটি, পেস্ট্রি, ডোনাট, বার্গার, মিষ্টিসহ আরও হরেক রকমের স্ন্যাকস আইটেম পাবেন। কেকের মধ্যে আছে ফ্রুটস কেক, চকলেট কেক, ওভালটিন কেক, প্লেইন কেক। চাইলে পছন্দের ডিজাইন ও প্রয়োজন অনুযায়ী কেক বানিয়ে নিতে পারেন এখান থেকে।
দোকানে দেখতে পেলাম তারা ছোট বাচ্চাদের জন্য বানানো কেকগুলো তে ডোরেমন কার্টুনের ছবি ও ক্রিম দিয়ে কেকের ওপর ছোট ছোট পুতুল ডিজাইন করে রেখেছে। আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা কেক কিনতে গেলে তা পাউন্ড হিসেবে কিনি, কিন্তু ডিসেন্ট বেকারি তাদের কেকগুলো কেজি হিসেবে বিক্রি করে থাকে।
ডিসেন্টের ব্ল্যাক ফরেস্ট পেস্ট্রির প্রতি লেয়ারে ক্রিম আর চকলেটের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। তবে পেস্ট্রির খুব বেশি ভেরিয়েশন বা আইটেম না দেখে একটু হতাশ হতে হলো।
মিষ্টির মধ্যে তাদের আছে নানা পদ। তাদের বানানো আফলাতুনের খ্যাতি রয়েছে। বিশেষ এই মিষ্টির বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি দেখতে অনেকটা ছোট কেকের মতো যা তৈরি করা হয় কিসমিস ও বাদাম দিয়ে। এছাড়াও পাবেন বালুশাই, মাওয়ার লাড্ডু, রসগোল্লা, চমচম, লালমোহন, মিমি সন্দেশ, পেস্তা বরফি ও মতিচুরের লাড্ডুসহ নানারকমের মুখোরোচক মিষ্টান্ন। এখানে মিষ্টি খেতে চাইলে আপনার গুনতে হবে সর্বনিম্ন ২০ টাকা থেকে বক্স প্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত।
দোকানের বাহারি খাবারের পসরায় স্ন্যাকস আইটেমই ছিল বেশি। সিঙ্গারা, সমুচা, চিকেন রোল, চিকেন পেটিস, চিকেন স্যান্ডউইচ, চিকেন পাফ, চিকেন পাই, চিকেন শর্মাসহ আরও কয়েক রকমের নাস্তা। খাবারের নামগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছিলো তাদের দোকানে চিকেনের তৈরি খাবারের আধিপত্য বেশি।
কেন এতো জনপ্রিয়তা ডিসেন্টের
দামের জন্য খাবারের মানের পরিবর্তনে কখনো কোন আপোস করেনি ডিসেন্ট পেস্ট্রি শপ। শুরুর দিকে যখন কেক তৈরিতে অন্যরা ডালডা ব্যবহার করত, তখন তারাই ঢাকায় বাটারের তৈরি কেক বানায়। তখন থেকেই ধীরে ধীরে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। সেই থেকে আজও তারা সিঙ্গাপুর থেকে আনা বাটার দিয়ে কেক বানিয়ে যাচ্ছে। কম দামে ভালো কেকের জন্য তাদের আলাদা সুনাম রয়েছে। কেকের পাশে মূল্যতালিকায় দেখলাম তাদের সর্বনিম্ন কেকের দাম ৫৫০ টাকা থেকে শুরু। আর ছবি প্রিন্ট করা কেকের মূল্য প্রতি কেজি ৮০০ টাকা থেকে শুরু।
পুরান ঢাকাবাসীর কাছে তাদের দোকানের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে হালিম। যা শুধুমাত্র রোজার একমাস পাওয়া যায়। এই হালিমের বিশেষত্ব ও জনপ্রিয়তার নেপথ্যে রয়েছে এটি বানানোর প্রক্রিয়া। সাধারণত হালিমে মাংস ছোট ছোট টুকরো করে রান্না করা হয় আর এখানেই ডিসেন্টের ভিন্নতা। তারা তাদের হালিম রান্নায় টুকরো করা মাংসের বদলে মাংসগুলোকে ঝুড়ি ঝুড়ি করে তারপর রান্না করে। তাদের দোকানের বিখ্যাত এই হালিমের প্রতি কেজির মূল্য ৫৫০ টাকা থেকে শুরু।
দোকানে ঢুকে যে কেউ সিদ্ধান্তহীনতায় চলে যাবে যে, কোনটা রেখে কোনটা খাবে। আমার অবস্থাও অনেকটা এইরকম হয়েছিল চোখের সামনে সাজানো এতো রকমের খাবার দেখে। দোকানে আসা বেশিরভাগ ক্রেতাকেই দেখলাম চিকেন পেটিস কিনছেন। কর্মীদের মধ্যে একজন বলেন, এটা তাদের দোকানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় আর এখানকার মানুষের কাছে বেশ পছন্দের।
আগ্রহের সাথে চিকেন পেটিস খেতে খেতে আমিও অনুভব করলাম এটার স্বাদ অন্য পেটিসের চেয়ে কেন ভিন্ন। দেখলাম পেটিসে চিকেনের পরিমাণ যথেষ্ট ছিল, আর এটাতে যে ক্রিম ব্যবহার হয়েছে এটাই পেটিসের স্বাদকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। পেটিসের ভেতরের ক্রিমি পেস্টের স্বাদ অনেকটা মেয়োনিজের মতো মনে হলেও এটি আসলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দুধ দিয়ে তৈরি হয়। এই সুস্বাদু পেটিসটি খেতে পারবেন মাত্র ৫০ টাকায়।
আশেপাশে কেক, পেস্ট্রির অন্যান্য দোকান থাকলেও ডিসেন্টে খেতে ও কিনতে আসা লোকের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। খেতে আসা একজনের সাথে গল্প করতে করতে জানতে পারলাম, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সুবাদে প্রায় ৩ বছর হলো নবাবপুরে থাকছেন। ডিসেন্টে তিনি প্রায় বিকেলে খেতে আসেন। তার কাছে এখানকার লাড্ডু ও পেটিস খুব পছন্দের।
তবে ডিসেন্টে বসে খাবার ব্যবস্থা নেই। "এখানে দাঁড়িয়ে খেতে হয়, অনেক সময় ক্লাস করে এসে ক্লান্ত থাকি তাই যদি বসার জন্য ব্যবস্থা রাখা হতো তাহলে আরও সুবিধা হতো", মন্তব্য করেন তিনি।
তিন দশকের যাত্রা
গত ৩ দশক ধরে ডিসেন্টের পথচলা কেমন ছিল তা জানালেন অপারেশন ম্যানেজার হোসেন। তিনি বলেন, "এখন তো ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে সকল প্রকার রেসিপি অনলাইনে পাওয়া যায়। তাই হোমমেড কেক, পেস্ট্রির মতো বিজনেস অনেক বেড়ে গেছে আর মানুষ এখন ঘরে বসেই বানাতে পারছে। তবুও আমাদের জনপ্রিয়তা মানুষের কাছে সবসময়ই ছিল। বাজারে অনেক প্রতিষ্ঠান চলে আসাতে আমাদের প্রতিযোগিতা আগের থেকে বেড়ে গেছে। কিন্তু আমরা ঠিকই আমাদের খাবারের মান এবং জনপ্রিয়তা আগের মতো ধরে রাখতে পেরেছি।"
একরকম হতাশা থেকেই তিনি জানালেন, করোনাকালীন সময়ে তাদের ব্যবসা বেশ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয় যা এখনোও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তিনি জানান, "আমাদের আগে বড় বড় অর্ডারগুলো আসতো কর্পোরেট অফিস, আদালত থেকে যা করোনার জন্য অনেক কমে গেছে। সর্বনিম্ন ২০ জন থেকে আমরা আমাদের অগ্রিম অর্ডারগুলো নিয়ে থাকি। করোনার সময়ে আমাদের নিয়মিত খাবারের এবং দোকানের ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হয়েছে যা আমাদের ব্যবসায় বিরাট প্রভাব ফেলেছে।"
ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি জেলায় শাখা চালু করার ইচ্ছার কথা জানান তিনি।
এর বাইরে মতিঝিলে আছে তাদের 'ডিসেন্ট ক্যাটারিং'। ভোজনরসিকদের কাছে খাবারের মধ্যে কাচ্চি মানেই অন্যরকম একটা আবেগ। ডিসেন্ট ক্যাটারিংয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি, কাবাব, মোরগ পোলাও, শাহী পোলাওসহ পাওয়া যায় নানা রকমের মোগলীয় ফিউশন ধাঁচের খাবার। চাইলেই ফুডপান্ডা, পাঠাও বা অনলাইন পেজ থেকে আপনার পছন্দের খাবার অর্ডার করতে পারবেন এখান থেকে।