ভালোবাসা দিবসের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠার রহস্য কোথায়?
বিশ্বব্যাপী আজ যে ভ্যালেন্টাইনস ডে এমন মহাসমারোহে উদযাপিত হচ্ছে, এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কার? নিঃসন্দেহে, বিভিন্ন কোম্পানির মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির।
কোম্পানিগুলো নিজেদের পণ্যের কাটতি বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি বিশেষ দিনের সন্ধানে ছিল, এবং তাদের কাছে ভালোবাসা দিবসকেই মনে হয়েছে সেরা পছন্দ। যুগে যুগে তাই নিজেদের পণ্য বিক্রির জন্য নিত্যনতুন বিজ্ঞাপন প্রচার করতে গিয়ে তারা সামগ্রিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে ভ্যালেন্টাইনস ডে-র জনপ্রিয়তা, এবং একে ঘিরে সাধারণ মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা-উন্মাদনা।
চলুন দেখা যাক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির মার্কেটিং ক্যাম্পেইন কীভাবে ঘি ঢেলেছে ভালোবাসা দিবসের আগুনে!
১৭১৪
ভ্যালেন্টাইনস ডে-র সঙ্গে ফুলের, বিশেষত লাল গোলাপের, যোগসূত্র স্থাপনের কৃতিত্ব সুইডেনের দ্বিতীয় চার্লসের। তিনি ফুলের মাধ্যমে ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করেন। আর প্রতিটি ফুলের সঙ্গে থাকত আলাদা আলাদা বার্তা। এভাবেই লাল গোলাপকে ভালোবাসা ও রোমান্সের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ক্রমশ এই প্রচলন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। লাল গোলাপ হয়ে ওঠে ভালোবাসা দিবসের সমার্থক।
১৮২২
ইংল্যান্ডে ততদিনে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন উপহার ও কার্ড বিনিময়ের মাধ্যমে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপনের রেওয়াজ তৈরি হয়ে গেছে। বহু বছর ধরেই চলে আসছে এই রেওয়াজ। কিন্তু সেটিকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যায় ক্যাডবেরি চকলেট কোম্পানি। তারা প্রথম হার্ট-শেপের চকলেট বক্স বিক্রি করতে শুরু করে।
১৮৪৯
আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে, হাউল্যান্ড নামের এক কার্ড নির্মাতা ডজনখানেক ভ্যালেন্টাইনস ডে কার্ডের স্যাম্পল তৈরি করেন এবং সেগুলো তার ভাইয়ের হাতে তুলে দেন। তার ইচ্ছা ছিল, ভাই যে তাদের বাবার কোম্পানি এস এ হাউল্যান্ড অ্যান্ড সন্সের হয়ে সেলস ট্রিপে গিয়ে কার্ডগুলো বিক্রি করে আসতে পারে। হাউল্যান্ডের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ২০০ ডলার আয় করা। কিন্তু বাস্তবে তার ভাই হাজির হয় এরচেয়েও ২৫ গুণ বেশি টাকা হাতে করে। এভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়, ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষ্যে কার্ডের ব্যাপক আবেদন রয়েছে।
১৮৫০
উস্টার স্পাই পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয় হাউল্যান্ডের ভ্যালেন্টাইনস ডে কার্ডের বিজ্ঞাপন।
১৯০৭
দ্য হারশি চকলেট কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে হারশি কিসেস ক্যান্ডি। মজার ব্যাপার হলো, এই চকলেটের নাম 'কিসেস' রাখা হয়েছিল, কেননা যখনই চকলেটগুলো কারখানার কনভেয়ার বেল্টে পড়ত, চুমু খাওয়ার মতো শব্দ হতো!
১৯১০
ফ্লোরিস্টস' টেলিগ্রাফ ডেলিভারি প্রতিষ্ঠিত হয় এ বছর। এর মাধ্যমে এক জায়গায় বসে অর্ডার দিয়ে অন্য কোথাও ফুল ডেলিভারির ব্যবস্থা চালু হয়। তাই প্রথমবারের মতো গ্রাহকরা দূরে বসেই তাদের ভালোবাসার মানুষদের কাছে ফুল পাঠানোর সুযোগ পায়।
১৯৪৮
এ বছরই প্রথমবারের মতো ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে হীরার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। দ্য ডি বিয়ার্স নামের ডায়মন্ড কোম্পানি 'আ ডায়মন্ড ইজ ফরেভার' ক্যাম্পেইন চালু করে। এর মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে যায় যে দামি গহনাতেও হতে পারে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
১৯৮৫
১৯৮০-র দশক জুড়ে হলমার্কের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যালেন্টাইনস ডে-কে কেন্দ্র করে হরেক রকমের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে। ১৯৮৫ সালে এরকমই একটি বিজ্ঞাপনে হলমার্ককে আখ্যায়িত করা হয় 'দ্য ভ্যালেন্টাইনস ডে স্টোর' হিসেবে। সেখানে তাদের তৈরি করা কার্ড থেকে শুরু করে হার্ট-শেপের সব পণ্য একসঙ্গে প্রদর্শিত হয়।
১৯৮৬
যেন ক্যান্ডির নাম 'কিসেস' রেখেই চলছিল না! হারশি এবার ক্যান্ডিগুলোকে গোলাপি ও লাল রঙের ফয়েলে মুড়ে বিক্রি করতে থাকে। তাই এগুলো যে নির্দিষ্টভাবে ভ্যালেন্টাইনস উপলক্ষ্যেই তৈরি, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
২০০৪
নতুন শতকে নিউ মিডিয়াকে সাদরে গ্রহণ করে নেয় বিশ্ববাসী। তাই নিউ মিডিয়ায় খুবই উন্নতমানের, উচ্চ-বাজেটের বিজ্ঞাপন নির্মাণও শুরু হয়। সেরকমই একটি আইকনিক বিজ্ঞাপন ছিল 'লে ফিল্ম' নামক একটি মিনি-রোমান্স ড্রামা। চ্যানেল নাম্বার ৫ পারফিউমের বিজ্ঞাপন ছিল সেটি।
বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যায়, এক লোক এক তারকার প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। ওই তারকার চরিত্রে অভিনয় করেন নিকোল কিডম্যান। শেষমেশ তারকা নিজের খ্যাতিময় জীবনে ফিরে আসেন। যখন তিনি রেড কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন, তার প্রেমিকটি একটি তালিকা করে যে তার কোন কোন স্মৃতি সে আজীবন মনে রাখবে। এর মধ্যে ছিল শ্যানেল নাম্বার ৫ পারফিউমের সুগন্ধও।
২০১৩
২০১৩ সালে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি উবার 'রোমান্স অন ডিমান্ড' নামের একটি ক্যাম্পেইন শুরু করে। সেখানে তারা গ্রাহকদেরকে সুযোগ দেয় অ্যাপের মাধ্যমে ভালোবাসার মানুষের ঠিকানায় ফুল পাঠানোর।
২০১৬
নেটবেস নামের একটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিটিকস প্ল্যাটফর্ম 'ভ্যালেন্টাইনস ডে সেন্টিমেন্ট অ্যানালিসিস' প্রকাশ করে। তারা জানার চেষ্টা করেছিল যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষজন ভ্যালেন্টাইনস ডে-র ব্যাপারে কতটা আলোচনা করে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সব মিলিয়ে ৯০ লক্ষবার ভ্যালেন্টাইনস ডে-র উল্লেখ ঘটেছে, আর নির্দিষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে একটি ব্র্যান্ডের নাম — নেটফ্লিক্স।
২০১৮ থেকে বর্তমান
সাম্প্রতিক সময়ে ভ্যালেন্টাইনস ডে-কে কেন্দ্র করে মার্কেটিং ক্যাম্পেইনগুলো পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে গেছে। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়েছে তাদের সরব উপস্থিতি। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ছোট ছোট ব্র্যান্ডগুলোও, যাদের বড় অঙ্কের বাজেট ব্যয়ের সামর্থ্য নেই।
- ছবি ও তথ্যসূত্র- হাবস্পট