স্পঞ্জের মতো নরম যে রসগোল্লার স্বাদ মুখে লেগে থাকে আজীবন!
তখন সবেমাত্র ক্লাস টু-তে পড়ি। ফরিদপুর শহরের একটা আবাসিক স্কুলে। খালাতো ভাই একবার আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এলো। সাথে করে আনলো তেঁতুলতলার রসগোল্লা। একবার বসেই প্রায় আধা কেজি রসগোল্লা খেয়েছিলাম। স্পঞ্জের মতো নরম রসগোল্লা। সে স্বাদ মুখে লেগে আছে আজও।
বলছিলাম ফরিদপুরের বিখ্যাত 'খোকা মিয়ার মিষ্টি'র কথা। ফরিদপুর শহরের কমলাপুরে অবস্থিত এটি। নাম খোকা মিয়ার মিষ্টি হলেও স্থানীয়রা একে 'তেঁতুলতলার মিষ্টি' বলেই জানে। মূলত, দোকানটি কমলাপুর তেঁতুলতলা মোড়ে হওয়াতে এমন নাম।
এবার চলে আসা যাক সাম্প্রতিক অতীতে। সেদিন বিকেলে বেশ শীত পড়েছিল। ভাবলাম এমন আবহাওয়াতে গরম গরম রসগোল্লা খেতে পারলে মন্দ হয়না। এজন্য এক বন্ধুর সাথে সোজা তেঁতুলতলা গিয়ে হাজির হলাম। এখানে ছোটবড় মিলিয়ে ছয়টি মিষ্টির দোকান আছে। তবে, অন্যকোনো দোকানে না ঢুকে 'খোকা মিয়ার মিষ্টি'র দোকানে যাই। টেবিলে বসেই গরম রসগোল্লার সাথে নিমকি দিতে বলি।
দোকানের বর্তমান পরিচালক মো. আমির হোসেন। খোকা মিয়ার ছেলে। দোকানেই ছিলেন তিনি। অনেকদিন ধরে এ দোকানে মিষ্টি খেতে আসা হয়। সেই সুবাদে মো. আমির হোসেনের সাথে প্রায়ই দেখা হয়েছে। কিন্তু কখনো এ দোকানের ইতিহাস সম্পর্কে জানা হয়নি তেমন করে। এবার মিষ্টি খেতে খেতে তার সাথে নানা বিষয়ে আলাপ করলাম।
খোকা মিয়ার মিষ্টির দোকানের ইতিহাস বেশ পুরোনো। সদ্য ভারত স্বাধীন হয়েছে। মো. আমির হোসেনের বাবা খোকা মিয়া তখন যুবক। সপরিবারে কমলাপুরেই থাকেন। খোকা মিয়া ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। এজন্য পরিবারের হাল ধরতে হয় খুব তাড়াতাড়িই। ঠিক করলেন ব্যবসা করবেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে খোকা মিয়া কমলাপুরে তার দোকান শুরু করেন। আমির হোসেন বলেন, ''আজকের দিনের মতো এখানে তখন এত ব্যবসায়ীরা ছিলেন না। বাজার-ঘাটেরও তেমন প্রসার ঘটেনি। আমার জন্মের অনেক আগেই আমার পিতা এখানে মিষ্টির দোকান দেন। এখানে তার আগে কোনো মিষ্টির দোকান ছিল না।''
খোকা মিয়ার মিষ্টির দোকানের ইতিহাস সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু মনে করতে পারলেন না আমির হোসেন। তবে খোকা মিয়ার মৃত্যুর পর থেকে তিনিই এই দোকানের পরিচালক হিসাবে আছেন। দোকানের বর্তমান কর্তা ব্যক্তি কে, তা জানতে চাইলাম। আমির হোসেন পারিবারিকভাবে দোকান পরিচালনার কথা জানালেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার ছেলেকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ''আমরা সবাই মিলেই দোকান পরিচালনা করে থাকি। দোকানের লাভ-লোকসান সবাই মিলেই দেখি।''
রসগোল্লার এমন সুখ্যাতির পেছনের গল্পটা শুনতে চাইলাম। আমির হোসেন জানালেন এই রসগোল্লা বিক্রি শুরু করেছিলেন খোকা মিয়া। তখন অবশ্য এটি সাধারণ খাবার হোটেলই ছিল। এই এলাকায় জনসংখ্যা কম থাকায় তখন বেচাকেনা কম হতো। ফলে ব্যবসায় খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না খোকা মিয়া। এরপর মিষ্টির দোকান দেয়ার চিন্তা করলেন। তবে, শুরু থেকেই খোকা মিয়া শুধু রসগোল্লা-ই তৈরি করতেন। এখনো তা অব্যাহত আছে। খোকা মিয়া নিজ হাতেই রসগোল্লা বানাতেন। স্পঞ্জের মতো নরম রসগোল্লার খ্যাতি তখন থেকেই ছিল।
প্রতিদিন কী পরিমানে মিষ্টি তৈরী করা হয় এখানে?
রসগোল্লা তৈরি করতে হালকা তাপে বড় কড়াইতে দুধ ঢেলে ফুটতে দিতে হয়। এরপর দুধের ছানা হয়ে গেলে তা থেকে স্পঞ্জ রসগোল্লা তৈরি করা হয়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯০ লিটার গরুর দুধ প্রয়োজন হয় খোকা মিয়ার মিষ্টি'র দোকানে। এই দুধ কোনো একক ডেইরি ফার্মের থেকে সংগ্রহ করা হয়না কিংবা ব্যবহার করা হয়না কোনো প্যাকেটজাত দুধ। ফরিদপুরের অদূরে সদরপুর এলাকার কমপক্ষে ১৮টি বাড়ি থেকে প্রতিদিন সকালে দুধ সংগ্রহ করা হয়। কখনো গরুর খামারিগণ নিজেরা দুধ নিয়ে চলে আসেন খোকা মিয়ার মিষ্টির দোকানের সামনে।
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। সকাল থেকেই কর্মব্যস্ততায় সময় কাটে দোকানের কর্মচারীদের। বেলা বাড়ার সাথে ক্রেতাদের আনাগোনাও বাড়তে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার পিস মিষ্টি তৈরী করা হয় দোকানে। ছোট আকারের এসব রসগোল্লার প্রতিটির দাম ১০ টাকা। আর, প্রতিটি নিমকির দাম মাত্র ৫ টাকা। এদিক থেকে বলা যায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার টাকার মিষ্টান্ন বিক্রি করা হয়।
অবশ্য প্রতিদিনই এই হারে মিষ্টি তৈরি করা হয়না। সাধারনত শীতকালে বেশি মিষ্টি বিক্রি হয়। আমির হোসেন বলেন, ''করোনা মহামারির এ সময়ে অধিকাংশ ক্রেতা পার্সেল করে মিষ্টি নিয়ে যেতে পছন্দ করেন। আবার অনেক ফ্যামিলির সবাই মিলে বের হওয়াটাও সমস্যা। এ কারনে দোকানে বসে না খেয়ে, কিনে নিয়ে যান।"
বর্তমান অবস্থা
তেঁতুলতলার সবচেয়ে পুরনো এই দোকানটির বর্তমান অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক বলা যায় না। দোকানে ঢুকতেই মাত্র দুটি বেঞ্চির দেখা মেলে। সেগুলোর অবস্থাও বড্ড সেকেলে। দোকানের এক পাশেই মাটির তৈরী বড় আকারের চুলা আছে। এখানেই রসগোল্লা তৈরি করা হয়।
এখানে রসগোল্লা খেতে আসেন সব শ্রেণির লোকজন। বিকালের পর দোকানে ভীড় জমে। বেঞ্চিতে জায়গা খালি পেলে কেউ বসে পড়েন। কেউবা জায়গা না পেয়ে বন্ধুদের সাথে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। এখানে খেতে আসা আবু নাইম বিহন দোকানের পরিবেশ নিয়ে কথা বলছিলেন। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র বিহন তার বন্ধুদের নিয়ে এখানে খেতে এসেছেন। তিনি কিছুটা ক্ষোভের সুরেই বললেন, ''ঐতিহ্যবাহী এই দোকানটি ফরিদপুর শহরের প্রায় সকলের কাছেই পরিচিত। অনেকেই খোকা মিয়ার রসগোল্লা খেতে দূর থেকে ছুটে আসেন। মিষ্টি নিয়ে আমাদের কারোরই কোনো অসন্তোষ নেই। এখানের রসগোল্লা মুখে নিলে মনে হবে আপনি 'হাওয়া মিঠাই' খাচ্ছেন। খুবই নরম রসগোল্লা। কিন্তু এত বছরের একটা দোকানের পরিবেশ, সাজ সজ্জাতে পরিবর্তন করা জরুরী।''
আরেকজন ক্রেতা মুরাদ হাসান রসগোল্লা পার্সেল করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ''আসলেই দোকানের এত সুনাম শুনে যেকোন লোক এখানকার রসগোল্লা উপভোগ করতে আসলেন, আর এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করলেন- এতে করে দোকানের সুনাম ক্ষুন্ন হবে''।
দোকানের পরিবেশ ও সজ্জা বিষয়ে মো. আমির হোসেন বলেন, ''আমরা দোকানের ডেকোরেশন পরিবর্তন করতে চেয়েছি। কিন্তু গত দুই বছর ধরে চলমান লকডাউনসহ অন্যান্য কারনে দোকানের কাজে হাত দিতে পারছিনা। তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে হবে বলে আশা করি।''
বর্তমানে দোকানে মো. আমির হোসেন সহ আরো তিনজন কর্মচারী আছেন। এদের মধ্যে একজন রাঁধুনি। আমির হোসেন জানান, করোনা পরিস্থিতির কারনে তাদের ব্যবসা আগের মতো নেই। বেশ ভাটা পড়েছে এই দুই বছরে। ব্যবসা ঠিকমতো না চললেও নিয়মিত কর পরিশোধ করতে হয়েছে। আবার বেড়েছে অন্যান্য খরচ। সার্বিক দিক বিবেচনা করে দোকানের পরিসর বাড়ানো, পরিবেশ আরও উন্নত করে তোলার মতো বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আমির হোসেন।