স্ত্রীর প্রতি গভীর প্রেমে তৈরি হল তাজমহল- কিন্তু তার মূল্য চুকাতে হলো সাম্রাজ্য হারিয়ে
তাজমহল শুধু মোগল সাম্রাজ্যের নিদর্শন হিসেবে নয়, একইসঙ্গে বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক স্থাপত্য। মোগল সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে নিজেদের ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান রানি মমতাজ মহল। প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধিসৌধ প্রতিষ্ঠা করতে কোনো কার্পণ্য করেননি সম্রাট। কিন্তু, তাজমহল নির্মাণে তিনি এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েন যে ওদিকে মোগল সাম্রাজ্যের কোষাগার খালি হওয়া নিয়ে তার কোনো চিন্তাই ছিল না।
মোগলরা ছিল মঙ্গল বংশোদ্ভূত মুসলিম শাসক। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর ছিলেন চেঙ্গিস খানের বংশধর। মঙ্গল থেকেই মোগল শব্দের উদ্ভব। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত শাসনকালের মধ্যে ১৬ শতকের শেষদিকে মোগল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করে। সেসময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে ধনী সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিল মোগলরা। ভারতের প্রায় সবগুলো প্রদেশ ছাড়াও বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তানেও মোগল সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। মোগলরা সামরিক শক্তি, আর্থিক ও ব্যবসায়িক দক্ষতা, অমুসলিমদের প্রতি ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শিল্পকলার প্রতি ভালোবাসার জন্য সুপরিচিত ছিল।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাজমহল ধর্মীয় তীর্থস্থান ছাড়াও প্রেমিকযুগলদের রোমান্টিক ভ্রমণস্থল হিসেবে টিকে রয়েছে। ১৯৮৩ সালে তাজমহল ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০০৭ সালে ছয় মহাদেশের ভোটে তাজমহলকে আধুনিক বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
তাজমহলের নিচে শায়িত মমতাজ মহলের কাহিনি শোনা যাক। মমতাজ ওরফে আরজুমান্দ বানু বেগমের জন্ম আগ্রায় ১৫৯৩ সালে। পারস্যের অভিজাত পরিবারে তিনি জন্ম নেন। আরজুমান্দের বাবা সম্পর্কে সম্রাট জাহাঙ্গীরের (শাহজাহানের বাবা) শ্যালক। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান সম্পর্কে মমতাজের ফুপু ছিলেন। শাহজাহান তখন রাজকুমার খুররাম নামেই পরিচিত। আরজুমান্দকে এক নজর দেখেই খুররম তার প্রেমে পড়েন। ১৬০৭ সালে সম্পন্ন হয় তাদের বাগদান। ১৬১২ সালে বিয়ের পর খুররম আরজুমান্দের নতুন নাম রাখেন মমতাজ। অর্থাৎ, যাকে প্রাসাদের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে।
সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে মমতাজ দীর্ঘ ১৯ বছর মোগল সাম্রাজ্য পরিভ্রমণ করেন। তিনি প্রায় সবসময়ই সম্রাটের পাশে থাকতেন। এমনকি সামরিক অভিযানগুলোতেও সম্রাটকে সঙ্গ দিতেন। অন্তঃসত্ত্বা থাকার সময়গুলোতেও মমতাজ অভিযানগুলোয় সম্রাটের সঙ্গী হতেন। এমনকি শাহজাহান যখন নিজের বাবাকে উৎখাত করতে অভিযান চালায় তখনও মমতাজ তার সাথে ছিলেন।
মমতাজ ছিলেন শাহজাহানের অন্যতম আস্থাভাজন এবং পরামর্শদাতা। সেসময় রানিরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়াতেও নানান কূটনীতিতে অংশ নিতেন। তবে মমতাজ কখনোই নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেননি। বাবার মৃত্যুর একবছর পর ১৬২৮ সালে শাহজাহান সিংহাসনে বসার পরেও মমতাজ এসব থেকে দূরে ছিলেন।
সূক্ষ্মরুচি এবং শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক হওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন সম্রাট শাহজাহান। তিনি রত্নবিদ্যার প্রেমে পড়েছিলেন। সূক্ষ্ণ অলঙ্করণ ও ফুলের নকশা করতে পারা শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তিনি।
পূর্বসুরীদের ঐতিহ্য ধরে রেখে সম্রাট শাহজাহান স্থাপত্য নকশায় বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। লাল বেলেপাথর দিয়ে আগ্রা দুর্গ, মার্বেল ও টালির কাজের লাহোর দুর্গ এবং দিল্লির লালকেল্লা নির্মাণ করেছিলেন শাহজাহান। লাহোর এবং দিল্লিতে বহু আকর্ষণীয় মসজিদও তিনি নির্মাণ করেন। তবে তার নির্মিত সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা হলো তাজমহল।
মমতাজ এবং শাহজাহানের ১৪ সন্তানের মধ্যে সাতজন শিশুকাল অতিক্রম করেও বেঁচে ছিল। ১৬৩১ সালে শাহজাহান সামরিক অভিযানে থাকাকালে মমতাজ সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান। সম্রাট এরপর দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকলেও স্ত্রীর এই অকাল মৃত্যু মানতে পারেননি। পরবর্তী দুই দশক সম্রাট তাদের চিরন্তন প্রেমের সমাধি নির্মাণে মনোনিবেশ করেন।
সাম্রাজ্য পতনের বীজ:
তাজমহল নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সাম্রাজ্যের দায়-দায়িত্ব পালনে সম্রাট অমনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন। ১৬৫৮ সালে শাহজাহান ও মমতাজের ছেলে আওরঙ্গজেব তিন ভাইকে হত্যা করে বাবার কাছ থেকে সাম্রাজ্যের দখল নেন। ১৬৬৬ সালে শাহজাহানের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওরঙ্গজেব তাকে আগ্রা দুর্গে আটকে রাখেন।
তাজমহলের নির্মাণ পরিকল্পনা ও পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বে কোন কোন স্থপতি ছিলেন তা জানা না গেলেও- সাম্প্রতিক বিভিন্ন উপাখ্যানে এর নির্মাণের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে ইসমাইল খান, যিনি তুরস্কে গম্বুজ তৈরি করতেন। এছাড়া ছিলেন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার আমানত খান। প্রকল্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মুকরিমত খান এবং মীর আব্দুল করিম। সারা বিশ্বের অসংখ্য কারিগর তাজমহল অলঙ্করণে কাজ করেছিল। সবসময় সেরা উপকরণগুলোই নির্মাণে ব্যবহার করত।
রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা ব্যয়ভার- কোনোকিছুই তাজমহল নির্মাণকাজকে থামাতে পারেনি। দ্য সিল্ক রোডস-এ পিটার ফ্রাঙ্কোপ্যান লিখেছেন, "আমেরিকা থেকে নেওয়া সোনা ও রূপা এশিয়ায় যাওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে; সম্পদের এই পুনর্বন্টনেই তাজমহল নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল।" রেড ইন্ডিয়ানদের উল্লেখ করে তিনি বলেন, "দুঃখের বিষয় হলো ভারতের গৌরবময় এই স্থাপনা নির্মাণের জন্য পৃথিবীর আরেক প্রান্তেও 'ইন্ডিয়ানরাই' খেটে মরছিল।"
১৬৭৬ সালে পারস্য এবং ভারত ভ্রমণের বিবরণ লিখেন ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী জিন-ব্যাপটিস্ট ট্যাভার্নিয়ার। তিনি লিখেন, প্রকল্পটিতে ২০ হাজারের বেশি কর্মী (এবং ১,০০০ হাতি) ছিল। এসব শ্রমিকদের অবস্থা কেমন ছিল এবং তাদের সঙ্গে কী করা হয়েছিল- তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে এখনও বিতর্ক রয়েছে। তবে এই ব্যয়ের সবটাই মোটা কর আদায়ের মাধ্যমে সংগৃহীত হতো।
মাকরানার খনির বিশুদ্ধ সাদা মার্বেল দিয়ে নির্মিত তাজমহল তৈরি করতে ১৬ বছর সময় লেগেছিল। ১৬৫৩ সালে ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। তাজমহল নির্মাণ মোগল সাম্রাজ্যের কোষাগার খালি করে ফেললেও তা ব্যর্থ যায়নি। তাজমহল এখন ভারতের সর্বজনীন প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সারাবিশ্বেই অনিন্দ্য শিল্প স্থাপনার মর্যাদা পেয়েছে তাজমহল।
ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্যতম প্রধান শহর আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে তাজ। তাজমহলের চারপাশে রয়েছে সুশোভিত বাগান, যেখানে খালের মাধ্যমে সেচকাজ সম্পন্ন হয়। ভবনটি ৪২ একর আয়তক্ষেত্রাকার এলাকাজুড়ে অবস্থিত যার চারপাশে প্রাচীর ঘেরা রয়েছে। ভেতরে প্রবেশের জন্য অবশ্যই ইওয়ান নামে তিনতলা উঁচু বিশাল প্রবেশদ্বার পার করতে হবে। লাল বেলেপাথরে নির্মিত কাঠামোটির সম্মুখভাগ বেলেপাথরে তৈরি।
সমাধিটি চোখের সামনে ধরা দেওয়ার মুহূর্ত হতে পারে শ্বাসরুদ্ধকর। ইন্দো-পার্সিয়ান সমাধিগুলোর মতো কেন্দ্রস্থলে থাকার পরিবর্তে মার্বেলের সমাধিটি উদ্যানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। দীর্ঘ আয়তক্ষেত্রাকার জলাধারে প্রতিফলিত হয় এর ছবি। মূল সমাধির পাশে লাল বেলেপাথরের দুটি দালান রয়েছে। এর মধ্যে একটি মসজিদ যা বাম দিকে মক্কামুখী। অন্যটি হলো ডানদিকে মুখ করা জওয়াব (মসজিদের প্রতিধ্বনি)। মসজিদ এবং জওয়াব প্রতিটির উপরে দুটি বড় ছাউনি রয়েছে— গম্বুজের নিচে এধরনের সুউচ্চ ছাউনি ভারতীয় স্থাপত্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি স্থাপত্য কৌশল।
স্থাপত্যশৈলীর অনুপাতে সূক্ষ্ম সাদৃশ্যের জন্য বিখ্যাত তাজমহল। পুরো তাজমহলের ভারসাম্য বজায় রাখতে এখানকার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আলোর পরিবর্তনের সাথে সাথে মার্বেলগুলোর রঙও পরিবর্তিত হয়। মধ্যাহ্নের জ্বলজ্বলে সূর্যের নীচে তাজমহলকে চকচকে সাদা দেখাবে। আবার ভোরের সময় গোলাপী আর চাঁদের আলোয় তাজমহলকে স্বচ্ছ বলে মনে হবে।
তাজমহলের অসামান্য সৌন্দর্য শুধু এর মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য কৌশলের জন্য নয় বরং এর চমৎকার সূক্ষ্ম অলঙ্করণগুলোর জন্যও ফুটে উঠে। সাদা মার্বেলে সেট করা পিট্রা ডুরার (কঠিন পাথর) এই নকশা ভারতে পারচিঙ্করি নামে পরিচিত। নকশাগুলো একইসঙ্গে জটিল এবং উজ্জ্বল। লতাপাতার মোটিফ, ফুল এবং ফুলদানি (গুলদাস্তা) যেন স্বর্গের ইঙ্গিত করে। এরসঙ্গে আছে দেওয়ালে চমৎকার ক্যালিগ্রাফি করা কুরআনের আয়াত।
ব্রিটিশ লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং প্রথমবার তাজমহল দেখতে ট্রেনে চড়ে এসেছিলেন। তিনি তাজমহলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: "তাজ একশ রকমের আকৃতি নিয়েছে; প্রতিটি আঙ্গিকই নিখুঁত এবং বর্ণনাতীত। এটা সেই দরজা যার মধ্য দিয়ে সব ভাল স্বপ্ন আসবে।"
তাজমহল দেখে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একইভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, "শুধু থাক একবিন্দু নয়নের জল, কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল"- এই জল আর কিছু নয়, মমতাজের জন্য শাহজাহানের অশ্রুবিন্দু।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক