চীনে জাতীয়তাবাদ যেভাবে নাইকি ও অ্যাডিডাসের রাজত্ব কেড়ে নিয়েছে
চীন, ১৪০ কোটি ক্রেতার বাজার। অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে আয়বৃদ্ধির কারণে এক সময় এ বাজারকে অব্যবহৃত সোনার খনি রুপে দেখেছে পশ্চিমা দুনিয়ার নামীদামি ব্র্যান্ড। পশ্চিমা পণ্যের প্রতি নতুন ভোক্তাদের আগ্রহও ছিল এর বড় কারণ। ফলে নাইকি ইঙ্ক থেকে শুরু করে নেসলে এসএ'র মতো বড় কোম্পানিগুলো আশা করেছিল চীনই হবে তাদের প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি।
হিসাবের এই ছক পাল্টে গেছে হঠাৎ করেই। চীন শুধু ভোক্তাবাজার নয়, হয়ে উঠেছে বড় প্রতিযোগী। সাইবার নিরাপত্তা থেকে শুরু করে প্রায় সব খাতেই পাল্লা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকি বিশ্বের সাথে। মানবাধিকারসহ বাণিজ্যিক ইস্যুতেও পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে বৈরিতা বাড়ছে দেশটির। চীনের নাগরিকরাও নিজ সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে তাল মিলিয়ে বিদেশি পণ্য বাছবিচার করছে—বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর জন্য যা হয়ে উঠেছে বড় উদ্বেগের কারণ। এতে ৬ লাখ কোটি ডলারের বাজারে নিজেদের অবস্থান নিয়ে সংশয়ে পড়েছে তারা।
সাধারণ স্নিকার বা জুতোর কথাই বলা যাক। অনলাইনে চীনের সবচেয়ে বড় খুচরা পণ্য বিক্রির প্ল্যাটফর্ম আলিবাবা গ্রুপ হোল্ডিং লিমিটেটের টিমল- এর চার বছরের লেনদেনের তথ্যেই উঠে এসেছে চীনাদের জাতীয়তাবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ার দিকটি। ভোক্তারা পশ্চিমা ব্র্যান্ড বিমুখ হয়ে এসময় ব্যাপক হারে ঝুঁকে পড়েছে স্থানীয় পণ্যে (স্নিকারে)। সেজন্য তারা কোটি কোটি ডলার মূল্যের কেনাকাটাও করছে।
অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায়, রাজনীতির গতির সাথে তাল মেলাচ্ছেন চীনা ভোক্তারা। রাজনীতির স্রোত যখন-যেদিকে তারাও সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন গাঁটের পয়সা খরচের ক্ষেত্রে। আগে যতোটা অনুমান করা সম্ভব হয়নি- এখন দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি ধারাবাহিক ও নিবিড়ভাবে পণ্য বিচার করছেন তারা।
বিদেশি পণ্যে ভাটা:
চীনে বিদেশি ব্র্যান্ডের বিক্রিবাট্টা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে, অন্যদিকে ফুলেফেঁপে উঠছে তাদের প্রতিযোগী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম ও বাণিজ্যিক তথ্য পরিবেশক ব্লুমবার্গ নিউজ চীনের হানঝৌ ভিত্তিক তথ্য-বিশ্লেষক ফার্ম তাওসজ ডটকমের প্রদত্ত তথ্য সংকলন করেছে। বিন্যস্ত তথ্যে উঠে এসেছে যে, মার্সিডিজ বেঞ্জ গ্রুপ এজি থেকে শুরু করে ক্রিশ্চিয়ান ডিওর এসই, ডলস অ্যান্ড গ্যাবানার মতো বিদেশি কোম্পানিগুলো মাঝেমধ্যেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির জেরে চীনে সরকারি রোষানলে পড়ছে—তা ভোক্তাদের মাঝেও ফেলছে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ। অনেক ক্রেতা তাতে করে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
এমন একটি ঘটনার উদাহরণ ২০২১ সালের মার্চ মাস। ওই সময়ে উইঘুর মুসলমানদের ওপর নির্যাতন এবং তাদের দাসের মতো তুলা উৎপাদনে ব্যবহারের অভিযোগ তোলে পশ্চিমা বিশ্ব। সমালোচনার মুখে চীন থেকে তুলা কেনা বন্ধ/ কমানোর অঙ্গীকার করে বেশকিছু বিদেশি স্নিকার ও স্পোর্টসওয়্যার ব্র্যান্ড। চীনা ভোক্তাদের তরফ থেকে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। ফলাফল প্রথমবারের মতো চীনের স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো তাদের পশ্চিমা প্রতিযোগীদের বেচাবিক্রিতে ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ড করে বসে।
নাইকি ও অ্যাডিডাস জিনজিয়াং প্রদেশে উৎপাদিত তুলা বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায়, তাদের বিক্রি আর্থিক গ্রাফে খাড়া পতন লক্ষ্য করে। এখনও সেই তলানি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা।
চীনের স্থানীয় ব্র্যান্ড অ্যান্টা স্পোর্টস প্রোডাক্টস লিমিটেড এবং লি নিং কোং- জিনজিয়ানে উৎপাদিত তুলা কেনাকে সমর্থন জানিয়ে আগেই বিবৃতি দিয়েছিল। তারা ছিল পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোর স্থানীয় প্রতিযোগী। ওই টানাপোড়েনের কয়েক মাস পর তাদের বেচাবিক্রি পশ্চিমা সংস্থাগুলোকে পেছনে ফেলে।
স্থানীয় কোম্পানিগুলো রাজনৈতিক এ দ্বন্দ্বের সুযোগে ভোক্তাদের জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে পুঁজি করেছে। এসময় তারা চীনা ঐতিহ্য ও নকশার সোয়েটার, স্নিকার ইত্যাদি বাজারে আনে।
এছাড়া ওই বছরের জুলাইয়ে চীনের হেনান প্রদেশে ভয়াবহ বন্যা এবং ২০২২ সালে শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজনের মতো ঘটনাও ভোক্তাদের জাতীয়তাবাদী পছন্দ-অপছন্দকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
এই জোয়ারে ভেসে ২০২২ সালের জানুয়ারির শেষ নাগাদ অ্যান্টা ও লি নিং দেশটিতে মোট বিক্রি হওয়া স্নিকারের ২৮ শতাংশ করেছে। জিনজিয়াং নিয়ে মানবাধিকার বিতর্ক সৃষ্টির আগের সময়ের চেয়ে যা ১২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।
৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত গত ১২ মাসে চীন ছিল পশ্চিমা বিশ্বের লক্ষ্যবস্তু। করোনামহামারির কারণে বছরের সিংহভাগ সময়েই বন্ধ ছিল দেশটির সীমান্ত। এ সময়ে ভাইরাসের উৎস নিয়েও অভিযোগের তীর ছোঁড়া হয় বেইজিংকে লক্ষ্য করে। চীনা ক্রেতারা তাদের দেশ নিয়ে এই নিন্দা-সমালোচনা ভালোভাবে নেননি। এসময়ে চীনের শীর্ষ স্নিকার ব্র্যান্ডগুলোর মোট বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ হওয়ায় তা প্রমাণ করছে। একইসঙ্গে, বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মোট বিক্রি কমে ২৪ শতাংশ।
ভূরাজনীতি শুধু স্নিকারে নয়, প্রসাধনী, কোমল পানীয়, শিশুখাদ্য, পোশাক—প্রায় সব পণ্যের বাজারেও রেখেছে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। এরমধ্যেই চীনে নেসলের মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ড স্থানীয় প্রতিযোগীর কাছে অনলাইনে শীর্ষ বিক্রয়কারীর আসন হারিয়েছে। এতে দীর্ঘদিনের রাজত্বের অবসান হয়েছে নেসলের।
তবে সৌন্দর্যচর্চা ও বিলাসপণ্যে এখনও নিজেদের আসন ধরে রেখেছে পশ্চিমা জায়ান্টরা, তবে তাদের সিংহাসন থেকে হঠাতে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোও খুব একটা পিছিয়ে নেই।
টিমল প্রদত্ত তথ্যে শীর্ষ স্পোর্টসওয়্যার ব্র্যান্ড:
বিক্রয় অংশীদারিত্ব (শতাংশ হিসাবে)
পরামর্শক ফার্ম প্রোফেট- এর ব্র্যান্ডিং অ্যান্ড মার্কেটিং বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জে মিলিকেন বলেন, "দেশের সমালোচনা-নিন্দার মতো নেতিবাচক ঘটনায় চীনা ভোক্তারা জোটবদ্ধ হয়ে আরো সক্রিয় জাতীয়তাবাদে ঝুঁকেছেন। 'তারা যেন বলছেন, দেশ নিয়ে নিন্দা করায় আমরা ক্ষুদ্ধ হয়েছি'। এখন চারপাশে তাকালেই মানুষের এ চিন্তা-চেতনা স্পষ্ট বোঝা যায়।"
ঐতিহাসিক পালাবদলের ক্ষণ!
যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের ক্রেতারাই বেশি যুক্ত ডিজিটাল মাধ্যমে। ফলে তারা সেখানে কেনাকাটাও বেশি করেন। তাই অনলাইন বিক্রির সাফল্য/ ব্যর্থতা কোনো ব্র্যান্ডের ব্যাপারে ক্রেতাদের মনোভাব বাস্তব আলোকে তুলে ধরে। তাছাড়া চীন এমন এক দেশ যেখানে মোট কেনাকাটার অর্ধেক হয় ই-কমার্সের মাধ্যমে।
জাতীয়তাবাদ দেশজ পণ্য কেনায় মানুষের আগ্রহ বাড়াতে পারে ঠিকই- কিন্তু চীনের ব্র্যান্ডগুলোকেও তাদের পণ্যে গুণগত মান ধরে রাখতে হবে, থাকতে হবে নতুন উদ্ভাবনা ও সৃজনশীলতার ছাপ। ক্রেতা প্রবণতা তৈরিতেও হতে হবে পারদর্শী, কারণ ইতোমধ্যেই তাতে সিদ্ধহস্ত বৈশ্বিক জায়ান্টরা।
সাংহাই ভিত্তিক বাজার গবেষণা সংস্থা ক্যান্টার ওয়ার্ল্ডপ্যানেল গ্রেটার চায়নার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জেসন ইয়ু বলেন, "প্রায় শূন্য থেকে প্রথমে ১, তারপর ১০ অর্জন করছে চীনা কোম্পানিগুলো। কিন্তু ১০ থেকে ১০০ পর্যন্ত যেতে তাদের শক্তির ঘাটতি রয়েছে। বর্তমান প্রবৃদ্ধি কীভাবে ধরে রাখা যায় সেব্যাপারে তাদের গভীরভাবে বাজার অধ্যয়ন করতে হবে।"
- সূত্র: ব্লুমবার্গ