মাধ্যমিক পর্যায়ের গ্রেড ইনফ্লেশন ও একটি বিশ্লেষণ
মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন সারা পৃথিবী জুড়েই একটি আলোচিত বিষয়- কেননা এটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে গ্রাস করে ফেলে। পৃথিবীতে সম্পদ সীমিত আর সেই সম্পদকে যখন গুণগত মানের কোন পরিবর্তন ছাড়াই আগের চেয়ে অধিক মূল্যে সংগ্রহ করতে হয়- তখন অর্থের মূল্য কমে যায় সেটাকে বলা হয় ইনফ্লেশন। অর্থনীতিবিদগণ অনেক সময় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং পণ্য ও সেবার গুণগতমান বিবেচনায় সীমিত পরিসরে মুদ্রাস্ফীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তবে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একাডেমিক গ্রেড ইনফ্লেশন একটি আলোচিত বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর একাডেমিক গ্রেড হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম একটি মাপকাঠি যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা পরিমাপ করা যায়।
গ্রেড ইনফ্লেশনের ধারণাটা বোধ করি যুক্তরাষ্ট্র থেকেই শুরু হয়। ১৯৬০ সালের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ব্যাপক হারে আমেরিকান সৈন্য ভিয়েতনামে পাঠাতে থাকে। এসময় সেনাসদস্যের ঘাটতি দেখা দিলে আমেরিকান সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ে যাদের জিপিএ ৪ এর মধ্যে ৩ এর চেয়ে কম থাকবে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক করে। এজন্য তুলনামূলকভাবে কম-সক্ষম ছাত্রদেরকেও সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া থেকে বাঁচানোর জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চাপে শিক্ষকরা বেশি করে গ্রেড দিতে থাকে। তখন থেকেই আমেরিকায় গ্রেড ইনফ্লেশন ধারণার প্রবর্তন হয়।
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা যায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৯৯৮ সালে 'এ' গ্রেড প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৯ শতাংশ আর ২০১৬ সালে সেই হার দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশে অর্থাৎ বিগত ১৮ বছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ শতাংশ। তবে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ঐ ১৮ বছরে ১৬০০ পয়েন্টের স্ট্যান্ডার্ড অ্যাপটিটিউড টেস্ট (স্যাট) পরীক্ষায় গড়পড়তা পয়েন্ট কমেছে ২৪। গড়পড়তা পয়েন্ট কমার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও তা অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে।
ভারতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পর্যায়ে পরিচালিত বেশ কিছু শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই) এর সিলেবাস ও মূল্যায়ন পদ্ধতি তুলনামূলক বিচারে যেমন কঠিন তেমনি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার মানও বেশ ভালো। এই সিবিএসই ২০১০ সাল হতে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করে এবং এর আওতায় ২.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ গ্রেড এ-১ পায়। তবে ২০২০ সালে দশম শ্রেণির জন্য আয়োজিত পরীক্ষায় ৯.৮৪ শতাংশ সর্বোচ্চ গ্রেড এ-১ পায়। করোনার কারণে পরীক্ষা পদ্ধতির কিছুটা শিথিলতার কারণে ২০২১ সালে এই হার দাঁড়িয়েছে ১১.৯২ শতাংশে।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম গ্রেড পদ্ধতি চালু হয় ২০০১ সালে। ঐ বছর প্রায় ৮ লক্ষ শিক্ষার্থী এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আর এদের মধ্যে ৩৫.২২ শতাংশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। যে সকল শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয় এর মধ্যে মাত্র ৭৬ জন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ গ্রেড এ-প্লাস পায়। ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, সারা দেশে ২২ লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৯৩.৫৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ১,৮৩,৩৪০ জন।
অন্যদিকে, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ২০০৩ সাল হতে জিপিএ পদ্ধতির যাত্রা হয় ২০ জন শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ প্রাপ্তি দিয়ে। ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৮৯,১৬৯ জন। তবে যে সকল শিক্ষার্থী ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল তারাই ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং ২০১৯ সালে তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১০৫,৫৯৪ জন।
এই অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভালো ফলাফল অবশ্যই অভিনন্দন যোগ্য। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহে একাডেমিক গ্রেডের পাশাপাশি উন্নত দেশসমূহের মতো কোন স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্ট চালু করা যায়নি যার মাধ্যমে একাডেমিক ফলাফলের মানকে ক্রস-চেক করা যায়। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের জন্য স্যাট (স্কলাস্টিক অ্যাপটিটিউড টেস্ট) বা চীনে গাওকাও (ন্যাশনাল কলেজ এন্ট্রান্স এক্সাম রয়েছে। অথবা এসকল শিক্ষার্থীর পরবর্তী শিক্ষাজীবনে তাদের অর্জন কিরূপ তা পরিমাপের কোন পদ্ধতি বা ডাটাবেজ আমাদের দেশে নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই কম-বেশি গ্রেড ইনফ্লেশন হয়েছে তবে এর মাত্রা কেমন এবং সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে কতটুকু সফল হতে পারছে- তা শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় গবেষণার বিষয়।
শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতেই পারে। তবে সম্পদ যেহেতু সীমিত তাই সবখানেই আমাদের চাহিদা ও সরবরাহ-এর বিষয়টা থেকেই যায়। যদি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হতে পারাকে একটা যোগ্যতা হিসেবে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে ২০১৯ সালের বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, দেশের ৪৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে মোট আসন সংখ্যা ৪৭, ১৭১টি। মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরোও দশ সহস্রাধিক আসন থাকলেও এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় শুধুমাত্র জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বেশিরভাই কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বর্তমানে পরীক্ষার মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে লেটার গ্রেড প্রচলিত হয়ে আসছে। এখন দেখা যাক, লেটার গ্রেড প্রচলিত দেশসমূহে সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির জন্য কি রকম মার্কস পেতে হয়? সাধারনত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে মাধ্যমিক পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় মোট ০৫টি (এ, বি, সি, ডি, এফ) গ্রেড রয়েছে এবং সর্বোচ্চ গ্রেড এ পাওয়ার জন্য ৯০ থেকে ১০০ মার্কস পেতে হয়। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট ০৯টি গ্রেড রয়েছে এবং সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির জন্য ৯০ থেকে ১০০ মার্কস পেতে হয়। ইসরায়েল, জর্ডানসহ কিছু দেশে সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির জন্য ৯৫-১০০ মার্কসের প্রয়োজন। কিছু দেশে সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির জন্য ৮০-১০০ মার্কস থাকলেও বেশিরভাগ দেশেই দেখা যায় সর্বোচ্চ গ্রেডের জন্য ৯০-১০০ মার্কের রেঞ্জ বজায় রেখেছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে এসএসসি পরীক্ষায় মোট ৭ ধরনের লেটার গ্রেড রয়েছে এবং সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির জন্য ৮০-১০০ মার্কসের প্রয়োজন অর্থাৎ ২০ মার্কসের রেঞ্জ! যদিও এ-প্লাস বাদে অন্যান্য গ্রেডের ক্ষেত্রে এই রেঞ্জ ১০ মার্কস রাখা হয়েছে। সে হিসেবে অন্যান্য গ্রেডের রেঞ্জ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রচলিত গ্রেড পদ্ধতিতে মার্কস ডিস্ট্রিবিউশন বিবেচনায় সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির জন্য বিশ মার্কসের ব্যাপ্তিটা একটু বেশিই মনে হয়।
বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে অন্যান্য দেশের মতো সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির জন্য ৮০-১০০ মার্কসের রেঞ্জ পরিবর্তন করে এই রেঞ্জ ৯০-১০০ করা উচিত। এছাড়া, প্রতি বিষয়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউশন তথা বিন্যাসে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমনঃ ৮টি লেটার গ্রেড থাকলে এক-অষ্টমাংশ শিক্ষার্থী একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড পাবে। অনুরূপভাবে, পরবর্তী গ্রেডগুলোতে এক-অষ্টমাংশ করে শিক্ষার্থী ঐ লেটারগ্রেডভুক্ত হবে। এক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীদেরকে সুনির্দিষ্ট মার্কসের জন্য দৌড়ানোর প্রতিযোগিতাও কমে যায়।
কোন দেশের মুদ্রাস্ফীতিকে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এর প্রভাব অনেক অর্থনীতিবিদ স্বল্পমেয়াদী বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি অবলম্বনের মাধ্যমে এর প্রভাবকে অল্প সময়ে একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু, শিক্ষা ব্যবস্থায় এই গ্রেড ইনফ্লেশনের প্রভাব শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদী নয়, দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি- যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল স্তরকে প্রভাবিত করতে পারে।
- [লেখক- বর্তমানে পিএইচডি শিক্ষার্থী
ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা, গ্রীন্সবোরো, যুক্তরাষ্ট্র]