হেলপার থেকে বস: যেভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক বাংলাদেশি গাড়ি মেকানিক ওয়ার্কশপের মালিক বনে গেলেন
২০০৫ সালে মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ যখন বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। সে সময় মাসিক ১০০০ দিরহাম বেতনে মেকানিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে আজ তিনি নিজেই একটি কার রিপেয়ার শপের (গাড়ি মেরামতের দোকান) মালিক। লাক্সারি এসইউভি গাড়ি মেরামত করা হয় আহসান উল্লাহর দোকানে।
চট্টগ্রাম থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসা এই প্রবাসী বাংলাদেশি এখন শারজাহতে একজন ব্যবসায়ী; তার অধীনে কাজ করছেন সাতজন মেকানিক ও কর্মী। কিন্তু গ্যারেজের হেল্পার থেকে ওয়ার্কশপের মালিক হয়ে ওঠার যাত্রাটা কেমন ছিল তার?
বিদেশে পাড়ি জমানো আর দশজন লোকের মতোই বড় স্বপ্ন নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসেছিলেন আহসান উল্লাহ- এবং তিনি সেই স্বপ্ন পূরণে সফলও হয়েছেন। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন, এই স্বপ্ন পূরণ সহজ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য, মিতব্যয়িতা, সততা ও কর্মক্ষেত্রে ক্রেতাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে আজ এই সফলতা লাভ করেছেন তিনি।
সফলতার পথে যাত্রা শুরু
কারিগরি স্কুলের পড়াশোনার পাট চুকিয়েই আহসান উল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন বড় ভাইয়ের পথ অনুসরণ করার। ২০০৫ সাল থেকে শারজাহতে আছেন তার ভাই।
আহসান উল্লাহ বলেন, "আমার ভাই মোজাম্মেল একজন মেকানিক ছিল এবং সেই আমাকে তার গ্যারেজে হেল্পারের কাজ পাইয়ে দেয়। আমি সিনিয়র মেকানিকদের গাড়ি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, ইঞ্জিন টিউন-আপ, তেল বদলানো, টায়ার ও ব্রেক চেক করা, স্পার্ক প্লাগ পাল্টানো এবং ব্যাটারি ও লাইট বদলানোর মতো ইলেক্ট্রিক কাজগুলোতে সাহায্য করতাম। আমি দোকানও পরিষ্কার করতাম, গাড়ি মেরামতের টুলগুলোতে নির্ধারিত জায়গায় রেখে আসতাম এবং আরও যেসব দায়িত্ব ছিল আমার উপর সেগুলো পালন করতাম।"
শুরুর দিকে ১০০০ দিরহাম বেতনে তার বেশ ভালোই চলে যেত বলে জানান আহসান উল্লাহ। কারণ তাকে গ্যারেজের ভেতরেই থাকার জায়গা দেওয়া হয়েছিল এবং এর জন্যে কোনো ভাড়া দিতে হতো না। খাওয়াপরার খরচ বাদে প্রতি মাসে দেশের বাড়িতে ৬০০ দিরহাম পাঠাতেন তিনি। কিন্তু এই আয় থেকেই মাসে ২০০ দিরহাম করে সঞ্চয় রাখতে ভোলেননি আহসান উল্লাহ।
তিন বছর পর যখন গাড়ি মেরামতের কাজে আরও দক্ষ হয়ে উঠলেন তখন তার বেতন বেড়ে গেল। সেই সাথে ড্রাইভিং লাইসেন্সও পেলেন যা তাকে ডেলিভারি ও ফ্যামিলি ড্রাইভার হিসেবে পার্ট-টাইম কাজ পেতে সাহায্য করে। আহসান উল্লাহ জানান, সে সময় পার্ট-টাইম কাজের আয়সহ তার মাসিক আয় ছিল ৪০০০ দিরহাম।
তবে আয় বাড়লেও নিজের জীবনযাত্রার ধরন বদলাননি এই প্রবাসী বাঙালি। তখনো গ্যারেজের বিনামূল্যের ঘরটিতেই থাকতেন এবং আরও বেশি সঞ্চয় করতে শুরু করেন। খাওয়া ও অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য মাত্র ৫০০ দিরহাম ব্যয় করতেন তিনি। বাবা-মাকে পাঠাতেন ১০০০ দিরহাম এবং মাসিক সঞ্চয় হিসেবে রাখতেন ২০০০ দিরহাম।
২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই রুটিনেই জীবন কাটিয়েছেন আহসান উল্লাহ। পাঁচ বছর মিতব্যয়ী জীবনযাপনের ফলাফল হিসেবে তার সঞ্চয় দাঁড়ায় ১০০,০০০ দিরহামে।
ঝোপ বুঝে কোপ
ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা জমা হবার পরেই নিজস্ব ব্যবসা চালু করার সিদ্ধান্ত নেন আহসান উল্লাহ। ভাইয়ের সাথে অংশীদার হয়ে ২০১৪ সালে নিজেরাই শারজাহ শিল্প নগরীর ১২ নম্বর এলাকায় একটি গাড়ি মেরামতের দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। লাক্সারি এসইউভি, ল্যান্ড রোভার, রেঞ্জ রোভার, জিপ এবং মার্সিডিজ-এএমজির মতো বিলাসবহুল গাড়িগুলো নিয়ে শুরু হয় তাদের কাজ।
প্রথম দিকে হাতেগোনা কয়েকজন ক্রেতা পেয়েছিলেন দুই ভাই- প্রবাসী ভারতীয়, যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তান এবং আমিরাতের গুটিকয়েক ক্রেতাও জুটেছিল তাদের। তবে সময়ের সাথে সাথে বিশ্বস্ত ক্রেতা গোষ্ঠী তৈরি করেন তারা এবং ব্যবসারও প্রসার ঘটে।
একক ব্যবসা
২০১৯ সালে আহসান উল্লাহ ঠিক করলেন, এবার নিজে একাই গাড়ি মেরামতের দোকান দিবেন। যেই ভাবা সেই কাজ, শারজাহ শিল্প নগরীর একই এলাকায় খুলে ফেললেন অ্যাডভেঞ্চার অটো মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ নামে একটি দোকান। ধীরে ধীরে এখানেও ক্রেতা গোষ্ঠী তৈরি হয়ে যায় তার এবং মেকানিক হিসেবেও নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যান আহসান উল্লাহ। গ্যারেজে কাজের মাধ্যমে পাওয়া ব্যবহারিক দক্ষতা তো ছিলই, এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের অধীনস্ত প্রযুক্তি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সনদ লাভ করেন।
চলার পথে ঝড়ঝাপ্টা
অন্য সব ব্যবসার মতো আহসান উল্লাহর গাড়ি মেরামতের ব্যবসাও ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তিনি বলেন, "করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দার ফলে আমার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গত বছর আস্তে আস্তে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছি এবং ২০২১ সালের শেষ দিকে এসে ব্যবসাকে আগের অবস্থানে নিয়ে আসতে পেরেছি। এখন আমার ব্যবসা বেশ ভালো চলছে।"
সফলতার গতিপথ
করোনাকালে আর্থিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার মন্ত্রও জানিয়েছেন আহসান উল্লাহ। তিনি বলেন, "আমরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি কারণ আমরা আমাদের ব্যবসায়ের মূলমন্ত্র থেকে দূরে সরে যাইনি; আর তা হলো- কখনো প্রতারণা করবে না, ক্রেতার কাছে বিশ্বস্ত থাকবে এবং ভালো সেবা দিবে।"
দুই ছেলের জনক এই ব্যবসায়ীর বর্তমান মাসিক আয় ৪০,০০০ দিরহামেরও বেশি। সব মিলিয়ে তার কর্মীর সংখ্যা সাতজন।
তবে বরাবরের মতো এখনো মিতব্যয়ী জীবনযাপন করেন আহসান উল্লাহ। তার দৈনন্দিন জীবনেও রয়েছে তার কাজের প্রতিফলন। ২০১৯ সালে মাত্র ১৫,০০০ দিরহামে যে রেঞ্জ রোভার গাড়ি কিনেছিলেন, এখনো সেটিই চালান তিনি। গাড়িটি মেরামত ও যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করতে তার খরচ হয়েছিল ১০,০০০ দিরহাম। আহসান উল্লাহ নিজেই এই এসইউভি গাড়িটি মেরামত করেন এবং তার ভাষ্যে, তার এই পুরনো গাড়িটি এখনো নতুন এসইউভি গাড়িই সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম। নিজের প্রতিভা ও গ্যারেজের কার্যক্ষমতা মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্যও এটিকে ব্যবহার করেন তিনি।
সূত্র: গালফ নিউজ