চা উৎপাদনে রেকর্ড, তবু কাটছে না আমদানি নির্ভরতা
দেশে বছর বছর চা উৎপাদন বেড়ে চলেছে। কিন্তু বার্ষিক ভোগের চেয়ে উৎপাদন বাড়লেও আমদানি এখনো কমেনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় চা বিপণন ও মোড়কজাতকারী কোম্পানিগুলো এখনো নিয়মিত চা আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটাচ্ছে। দেশে চা উৎপাদন বাড়লেও ভালো মানের চা উৎপাদনের পরিমাণ তুলনামূলক না বাড়ায় এখনো আমদানি নির্ভরতা কাটছে না বলে মনে করছে চা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
গত বছর ২০২১ সালে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেশে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। তা সত্ত্বেও বছরের শুরুতেই দেশের শীর্ষ কয়েকটি কোম্পানি চা আমদানির অনুমোদন নিয়েছে চা বোর্ড থেকে। অন্য কয়েকটি কোম্পানি চা আমদানির জন্য আবেদন করেছে। মূলত চা উৎপাদন বাড়লেও ভালো মানের চা উৎপাদনে পিছিয়ে থাকায় দেশের চা খাত এখনো শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করেনি। ভালো মানের চায়ের জন্য বিদেশমুখিতার পাশাপাশি দেশে অবিক্রিত নিম্নমানের চা রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
গত ৬ জানুয়ারি আবুল খায়ের গ্রুপ ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ কেজি চা আমদানির অনুমতি পেয়েছে। ছয়টি কনটেইনারে করে অনুমোদন পাওয়া এসব ব্ল্যাক টি আমদানি হচ্ছে কেনিয়া থেকে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি কেজি ব্ল্যাক টি আমদানি করছে ২ দশমিক ৫০ ডলারে। অন্যদিকে একই দিন ইস্পাহানি গ্রুপ কেনিয়া থেকে তিন ধাপে মোট ২৮৮ টন চা আমদানির অনুমোদন পেয়েছে। প্রতি ধাপে ৯৬ হাজার কেজি চা আমদানিতে গ্রুপটি খরচ করছে ১ লাখ ২০ হাজার ৯৬০ ডলার করে। অর্থাৎ একটি অনুমোদনে মোট তিন ধাপে ২ লাখ ৮৮ হাজার কেজি চা আমদানিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৮০ ডলার। বছরের শুরুতে এ পরিমাণ আমদানি ছাড়াও আবেদনের অনুমতি পেলে চলতি বছরই বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করবে শীর্ষ কোম্পানিগুলো।
চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে চা আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ২৫ হাজার কেজি। ২০২০ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৭১ হাজার কেজি। ২০১৯ সালে ১৫ লাখ ২৫ হাজার কেজি। ২০১৮ সালে ৭৪ লাখ ৩৯ হাজার কেজি এবং ২০১৭ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ৮৭ লাখ ৩২ হাজার কেজি।
একইভাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে শূন্য দশমিক ৬৮ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয়। ২০১৯ সালে রপ্তানির পরিমান ছিল শূন্য দশমিক ৬০ মিলিয়ন কেজি। এর আগের দুই বছর ২০১৮ সালে শূন্য দশমিক ৬৫ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১৭ সালে ২ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয়।
দেশে প্রথম সারির চা বাগানগুলো নিলামে প্রতি কেজি চা বিক্রি করছে গড়ে ২৬০-২৭০ টাকায়। অথচ সারা দেশের বাগানগুলোর গড় চা বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ২০০ টাকারও কমে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের সমতলের চা বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকা গড় দরে। মূলত দেশের প্রথম সারির দুই-তৃতীয়াংশ বাগানে চা উৎপাদন বেশি হলেও নিম্নমানের চা উৎপাদনই ভালো মানের চা উৎপাদনের বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন চা-সংশ্লিষ্টরা।
আমদানির বিষয়ে চা বোর্ডের উপ পরিচালক (বাণিজ্য) মদহুল কবির চৌধুরী বলেন, "এক সময় দেশে চা আমদানির পরিমাণ ছিল ৭০-৮০ লাখ কেজি। বছর বছর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে আমদানির পরিমাণ এখন ১০ লাখের নিচে চলে আসছে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা মানসম্মত চা উৎপাদনেও নজর দিচ্ছি।"
একাধিক চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, দেশে ১৬৭টি চা বাগান উৎপাদনে থাকলেও সিংহভাগই ভালো মানের চা উৎপাদন করে না। অধিকাংশ বাগান কর্তৃপক্ষই গুণগত মানের চেয়ে চা উৎপাদনের পরিমাণকে প্রাধান্য দেয়। নিয়মিত তদারক না করা, নতুন বিনিয়োগ না করার কারণে বাড়তি চা উৎপাদনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ লাভে থাকতে চায় এসব বাগান কর্তৃপক্ষ। যে কারণে দেশে প্রতি বছরই চা উৎপাদন বাড়লেও ভালোমানের চা উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়ায় ব্র্যান্ডেড কোম্পানিগুলোর বিদেশমুখিতা কমছে না।
দেশের শীর্ষস্থানীয় একাধিক ব্র্যান্ডেড কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে বলছেন, চা বোর্ড উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিলেও গুণগত মানের প্রশ্নে এখনো পিছিয়ে। যে কারণে চা আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের পরও জনপ্রিয় কোম্পানিগুলো চা আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা বাগান ও রুগ্ণ চা বাগান নিম্নমানের চা উৎপাদনের মাধ্যমে চায়ের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ভালো মানের চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে চা বোর্ড কঠোর অবস্থানে না গেলে পরিমাণ বাড়লেও দেশের চায়ের মান বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তারা।
২০০৬ সালে দেশে সর্বনিম্ন ৫ কোটি ৩৪ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। পরবর্তী সময়ে চা উৎপাদন বেড়ে ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজিতে উন্নীত হয়। এরপর ২০১৬ সালে উৎপাদন এক লাফে সাড়ে আট কোটি কেজিতে উন্নীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে দেশে চা উৎপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজি হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। করোনাকালে ২০২০ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজারে নামলেও সর্বশেষ ২০২১ সালে চা উৎপাদন উন্নীত হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজিতে।
দেশে ১৬৭টি চা বাগান থাকলেও এক দশকের বেশি সময় ধরে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় সমতলীয় জমিতে চা চাষ হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে উত্তরবঙ্গের সমতলের চা উৎপাদন ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। ২০২০ সালে উত্তরাঞ্চলের সমতলীয় ক্ষুদ্র চাষীরা উৎপাদন করেছিলেন ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা। কিন্তু ২০২১ সালে সমতলে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা, যা দেশে সার্বিক চা উৎপাদনের ১৫ শতাংশের বেশি।
চা আমদানির বিষয়ে এইচআরসি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (চা) মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, "দেশের ভোক্তারা ভালো চা পানে অভ্যস্ত। মূলত প্রিমিয়াম কোয়ালিটির চা ব্লেন্ডিংয়ের জন্য বিভিন্ন গ্রেডের চায়ের প্রয়োজন। শীর্ষস্থানীয় চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্র্যান্ডের গুণগত মান ধরে রাখতে ভালো চা সংগ্রহ করে। দেশের নিলামে পর্যাপ্ত ভালো চা না পেয়ে কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চা আমদানি করে। এ কারণে এখনো বাংলাদেশে চা উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও আমদানি হচ্ছে।"