আড়াই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেসরকারি খাতের ঋণ
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.০৭ শতাংশ বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে। সে হিসেবে জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত ২৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে।
কোভিডের তীব্রতা কমার পর দেশে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। টানা সাত মাস বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি চলতি বছরের জানুয়ারিতেও অব্যাহত ছিল। প্রায় আড়াই বছরের মধ্যে জানুয়ারির ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ।
এর আগে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৩২ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৬৬ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। গত বছর অর্থাৎ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪০ হাজার ২৩ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, অধিক পরিমাণ আমদানি বৃদ্ধি, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ার ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত আমদানি সংক্রান্ত হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সবমিলিয়ে ৪ হাজার ২১২ কোটি ২৫ লাখ (৪২ দশমিক ১২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ছয় মাসে ২ হাজার ৭২৬ কোটি ৯২ লাখ (২৭ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল, যা ছিল আগের বছরের (২০১৯-২০) জুলাই-ডিসেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) নতুন চেয়ারম্যান ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যদিও জানুয়ারিতে দীর্ঘদিন পরে এত বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টার্গেট থেকে তা অনেকটা কম।"
তিনি বলেন, "আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটলেও আবার নতুন করে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার এর কী প্রভাব পড়বে সেটা বোঝা কঠিন।"
"আমি মনে করি চলতি বছর খুবই কঠিন যাবে। আমরা যতটা পারি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের ওপর বাহ্যিক প্রভাব পড়ছে। তেলের দাম বাড়ছে, গমের দাম বাড়ছে, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে বহু দেশই শঙ্কিত। তবে প্রভাব এখনই বোঝা যাবে কি না নিশ্চিত নয়। চার-ছয়মাস পরেও তা দৃশ্যমান হতে পারে।"
"ইউরোপ বলছে রশিয়ার গ্যাস তারা নিবে না। এর কারণে গ্যাসের সংকট হবে কি না, তা নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই অনিশ্চয়তার কারণে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে ধস নামছে। আমরা ছোট দেশ হলেও একটি বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজের অংশ। কোথাও কিছু হলে সারা বিশ্বে তার প্রভাব পড়ে," বলেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো দিক। এর মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে। তার মানে নতুন বছর বিনিয়োগের একটি ইতিবাচক আবহ নিয়েই শুরু হচ্ছে।"
তিনি বলেন, চলতি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এর ফলে অর্থনীতিতে পুরোপুরি গতি ফিরবে। তবে এর বেশি হলে কিছুটা সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে।
চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল। সেখানে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর শেষে উদ্যোক্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে এখনও প্রায় ৪ শতাংশ ঋণ কম নিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোভিডের কারণে গত মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি খুবই কম ছিল। সে সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। এর পর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ছে।
২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে তা নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে।
তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার ঘটে। তারপর থেকে ঋণপ্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ।