দেশের প্রথম কোম্পানি হিসেবে বিদেশ থেকে জাহাজ পরিচালনা করতে যাচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক
প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবে বিদেশে শিপিং ও লজিস্টিকস খাতে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড।
কোম্পানিটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ফুজাইরা বন্দর থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য বন্দরে আমদানি পণ্য পরিবহনের জন্য আটটি জাহাজ পরিচালনা করবে।
কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, এই ব্যবস্থায় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আরও সহজে এবং কম খরচে পণ্য আমদানি করা যাবে।
২৮ ফেব্রুয়ারি সাইফ পাওয়ারটেক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) জানায় যে তারা জাহাজ পরিচালনার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাফিন ফিডার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
সাফিন ফিডার হলো আরব আমিরাতভিত্তিক কনটেইনার ফিডার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এডি পোর্টস গ্রুপ কর্তৃক ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি মূলত আরব উপসাগর ও ভারতীয় উপমহাদেশের কনটেইনার পরিবহন নেটওয়ার্কে সেবা দিয়ে থাকে।
এডি পোর্টস গ্রুপ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, চুক্তির শর্তাবলির আওতায় সাফিন ফিডারস ও সাইফ পাওয়ারটেক ১৫ বছরের মেয়াদে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে কার্গো সেবা দিতে একসঙ্গে কাজ করবে।
এই উদ্দেশ্যে সাইফ পাওয়ারটেক সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাইফ ইউনাইটেড শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং নামে একটি সহযোগী কোম্পানি চালু করেছে।
সাইফ পাওয়ারটেক ডিএসইকে আরও জানিয়েছে যে, পণ্য পরিবহনের জন্য তারা সাফিন ফিডার থেকে আটটি সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া করবে। জাহাজগুলো পরিচালনা করবে সাইফ ইউনাইটেড শিপিং।
প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া একটি বিবৃতিতে বলা হয়, সাইফ পাওয়ারটেক সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে শুষ্ক নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে জাহাজগুলো ব্যবহার করবে।
প্রত্যেকটি জাহাজের ধারণক্ষমতা হবে ৫৫ হাজার ডিডব্লিউটি। তবে এই ব্যবসা পরিচালনায় কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, সে তথ্য প্রকাশ করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিটি জাহাজ থেকে সাইফ পাওয়ারটেকের বছরে ১৫৪ কোটি টাকা আয় এবং ১৫ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা মুনাফা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে এডি পোর্টস গ্রুপ তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে তারা বাল্ক শিপিং সেবা দেবে। এমইএনএ (মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা) অঞ্চল এবং এশিয়ান উপমহাদেশের মধ্যে সামুদ্রিক বাণিজ্যে সেবা দেবে তারা।
বাংলাদেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামুদ্রিক অবকাঠামো ও প্রকল্পগুলোতে যৌথভাবে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য ভবিষ্যৎ-সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকেও এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৩ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ০.৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ইতিমধ্যেই ০.৪১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৫৮ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডেল করে দেশের একমাত্র টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক। কোম্পানিটি মোংলা ও পানগাঁও বন্দরেও কনটেইনার হ্যান্ডেল করে।
সংস্থাটি লজিস্টিক এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং স্বয়ংচালিত বা গাড়ির ব্যাটারির সাথে জড়িত।
পাশাপাশি কোম্পানিটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, লজিস্টিকস ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অটোমোটিভ বা গাড়ির ব্যাটারির ব্যবসাও করে।
সাইফ পাওয়ারটেকের বিনিয়োগ পরিকল্পনা
সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তরফদার মো. রুহুল আমিন বলেন, ব্যবসা বহুমুখীকরণের জন্য মোংলা বন্দরে মাল্টিমোডাল কনটেইনার টার্মিনাল, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং মোংলা বন্দরে একটি জেটি নির্মাণে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন তারা।
কোম্পানিটি ৪৭৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে উজবেকিস্তানের এরিয়েল সার্ভিস অ্যান্ড সাপোর্টের সঙ্গে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানে যুক্ত হয়েও ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে।
রুহুল আমিন বলেন, বর্তমানে দেশে সব গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কার্যক্রমই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো করে থাকে।
'আমরা নিজেরাই এটা করতে পারলে আমাদের টাকা বাঁচাতে পারতাম। তাছাড়া বাংলাদেশ এই ফিল্ডে দক্ষ পেশাদার পাবে। অন্যান্য সেক্টরে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও এখানে [এর জন্য] আমরা বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশ স্থানীয় বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পারবে।
রুহুল আমিন বলেন, 'এটি আমার জন্য লাভজনক না-ও হতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এই খাতে কীভাবে কাজ শুরু করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার সঙ্গে আলোচনা করছি।'
এছাড়া ২০২১ সালের অক্টোবরে সাইফ পাওয়ারটেকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাইফ লজিস্টিকস অ্যালায়েন্স আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হালিশহরে দেশের প্রথম মাল্টিমোডাল কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কনটেইনার কোম্পানি অভ বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল)-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে।
রুহুল আমিন জানাল, টার্মিনালটি ২০২৩ সালে চালু হবে।
এছাড়াও সাইফ পাওয়ারটেক মোংলা বন্দরে একটি বহুমুখী জেটি নির্মাণ করছে। এই জেটি নির্মাণে তারা প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। মোংলা বন্দরের এই জেটিতে কনটেইনার ও কার্গো জাহাজ উভয়ই হ্যান্ডল করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়াও কোম্পানিটি তথ্য প্রযুক্তি ব্যবসায় ৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সেখান থেকে তারা ১০০ কোটি টাকা আয় করবে বলে আশা করছে।
২০২১-২১ অর্থবছরে বন্দর পরিচালনা, ব্যাটারি ব্যবসা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাইফ পাওয়ারটেক ৪৭৯ দশমিক ৫০ কোটি টাকা আয় করেছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি।
একই বছরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ ও ৬ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়ে ৬২ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা লাভ করেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানিটির আয় কিছুটা বেড়ে ২১৭ দশমিক ৭২ কোটি টাকায় পৌঁছলেও গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নিট মুনাফা কমে ৩৭ দশমিক ৪৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
রুহুল আমিন বলেন, 'আমরা এখন মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠছি। সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজ আমাদের পরিস্থিতি বদলানোর রসদ জুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সাহায্যের জন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। এই প্রণোদনা অনেক ব্যবসায়ীকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে।'
বিদেশে জাহাজ পরিচালনার ব্যবসার ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও মঙ্গলবার ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ কমে ৩৯ দশমিক ৩০ টাকায় নেমে আসে।