রাশিয়ামুখী পণ্য বুকিং বন্ধ করে দিয়েছে শিপিং কোম্পানিগুলো, বিপাকে পোশাক রপ্তানিকারকরা
কাতার বিশ্বকাপের জন্য ৬ লাখ পিস ফিফার অফিশিয়াল টি শার্ট সরবরাহ করতে চট্টগ্রামের সনেট টেক্সটেইলকে কার্যাদেশ দিয়েছিলো রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান স্পোর্টমাস্টার। এর মধ্য থেকে ৩ লাখ পিস গত ফেব্রুয়ারিতে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৩ লাখ পিস শার্ট মার্চে হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বের শিপিং কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ায় পণ্যচালানটি সঠিক সময়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছাবে কিনা তা নিয়ে আশংকা তৈরী হয়েছে।
এদিকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের তৈরী পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বিপাকে পড়েছেন। অর্ডার বাতিল, ডিসকাউন্ট কিংবা পণ্যের মূল্য পাবে কিনা তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে কারখানা মালিকরা।
স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর অথবা কলম্বোর ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে ইউরোপের বন্দর ঘুরে রাশিয়ায় পণ্য নেওয়া হয়। আবার ইউরোপের বন্দরে নামানোর পর সড়কপথেও পণ্য রাশিয়ায় যায়। রাশিয়ায় পণ্য নিতে না পেরে এখন ইউরোপ ও আশপাশের দেশগুলোতে পণ্য নেওয়ার বিকল্প চেষ্টা শুরু করেছে ক্রেতারা।
সনেট টেক্সটাইলের পরিচালক গাজী মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ বলেন, "আমরা গত ফেব্রুয়ারিতে ৩ লাখ পিস টি শার্ট ক্রেতার মনোনীত ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের কাছে হস্তান্তর করি। পরবর্তী এডভাইস আমরা পাইনি। এডভাইস পেলে পণ্যটি শিপমেন্ট হয়েছে কিনা আমরা জানতে পারবো। শিপিং লাইন পণ্য না নেওয়ার কারণে পরবর্তী ৩ লাখ পিস টি শার্ট শিপমেন্ট এর বুকিং পাইনি। ক্রেতার সাথে আলোচনা চলছে। তারা রুট পরিবর্তন করে পণ্য নিয়ে যাবে বলে আমাদের জানিয়েছে।"
বিজিএমইএ সুত্র জানায়, বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের প্রায় ৫৫ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপ। ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাক রপ্তানি হয়। এরমধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৮৭ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। যা মোট রপ্তানির ১ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এদিকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গত ১ মার্চ থেকে রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেরিয়েন শিপিং কোম্পানি (এমএসসি)। একই সাথে রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে সিঙ্গাপুর-জাপানভিত্তিক ওয়ান লাইন, জার্মানিভিত্তিক হ্যাপাগ লয়েড, ডেনমার্কভিত্তিক মার্সক। অন্যান্য শিপিং কোম্পানিগুলোরও রাশিয়ায় পণ্য বুকিং নিতে অনীহা রয়েছে।
মেডিটেরনিয়ান শিপিং কোম্পানির হেড অব অপারেশন এন্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, "আমাদের প্রতিষ্ঠানে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন এবং গত ১ মার্চ থেকে রাশিয়ার পণ্য বুকিং নেওয়া বন্ধ রয়েছে। অন্যান্য প্রায় সকল শিপিং কোম্পানিগুলোও রাশিয়ায় পণ্য বুকিং নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে রাশিয়ায় প্রায় ১৫০ টিইইউএস কন্টেইনার পণ্য পাঠানো যেতো। যুদ্ধ পরিস্থিতি বন্ধ না হলে বুকিং নেওয়া শুরু করা যাবেনা।"
বিজিএমইএর সহ সভাপতি রাবিকুল আলম চৌধুরী বলেন, "যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান না হলে সমুদ্র পথে সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করা অনিশ্চিত হবে। তখন নতুন অর্ডার এবং সাপ্লাই চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী ক্রাইসিস শুরু হবে। রাশিয়া থেকে পণ্য আনতে এলসি করতে পারবে কিনা, পেমেন্ট দিতে পারবে কিনা, যুদ্ধ পরবর্তী এক দেশের সাথে আরেক দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক কেমন হবে তার উপর নির্ভর করবে অনেক কিছুই।
বিজিএমইএ সুত্র বলছে, রাশিয়া অভিমুখী পণ্য গার্মেন্টস কারখানাগুলো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে। জাহাজীকরণের উদ্দেশে পাঠানো রপ্তানি পণ্যের চালান আটকে আছে বেসরকারি আইসিডিগুলোতে। যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে রাশিয়ায় পণ্য পাঠানো অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
রাশিয়া অভিমুখে পণ্য বুকিং বন্ধ করে দেওয়ায় ১৬৬ কন্টেইনার পণ্য আটকে আছে বেসরকারি আইসিডিতে। রাশিয়ায় রপ্তানির উদ্দেশে আনা কন্টেইনার বোঝাই হয়নি এমন পণ্যও রয়েছে আইসিডির শেডে।
বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, "সাধারণত পণ্যের বুকিং পেলেই রপ্তানিকারকরা জাহাজীকরণের উদ্দেশে আইসিডিতে পণ্য পাঠায়। পণ্য বুকিং নেওয়া বন্ধ ঘোষণার আগে রাশিয়াগামী এসব পণ্য আইসিডিতে এসেছিলো।"
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় তাদের সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক লেনদেন-ব্যবস্থা সুইফটের মাধ্যমে রাশিয়ার ব্যাংক এর লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে ১২ মার্চ থেকে।
এদিকে এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্সের মতো পোশাকের বিশ্বখ্যাত খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড রাশিয়ায় তাদের বিক্রি সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। রাশিয়ায় এইচঅ্যান্ডএমের ১৫০টির বেশি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ইন্ডিটেক্সের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৫০২। বাংলাদেশের অন্যতম বড় ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম ব্র্যান্ড দুটি।
বিজিএমইএর পরিচালক ও ক্লিফটন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, "রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী পোশাক খাতসহ বিশ্ব বাণিজ্যকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। সুইফট থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করায় সরবরাহকৃত পোশাকের টাকা পেতে কিছুটা বিলম্ব হবে। এই সংকট কবে কমবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশেরন পরিচালক শাহেদ সরওয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাতে নতুন করে সংকটে ফেলে দেবে।
পোশাক খাতে মোট রপ্তানির অর্ধেকের বেশি গন্তব্য রাশিয়া ইউক্রেনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সে দেশের ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই কমে আসবে। ফলে তৈরী পোশাকের অর্ডার বাতিল কিংবা মূল্য পরিশোধে বড় ধরনের শংকা তৈরী হবে।
ইরাক ও অন্যান্য যুদ্ধের সময় ওয়ার রিস্ক সারচার্জ আরোপের প্রসঙ্গ এনে সাহেদ সরওয়ার আরও বলেন, "এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বড় শিপিং কোম্পানিগুলো ফ্রেইট চার্জের উপর সারচার্জ বসিয়ে দিতে পারে। তখন বিশ্বব্যাপী পণ্যের সাপ্লাই চেইনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে।"