পুতিনের মগজে স্তালিনের রঙ্গলীলার ছক
বিগত কয়েকদিন ধরে ভ্লাদিমির পুতিনের কাণ্ডকারখানায় তার মহান পূর্বসূরি জোসেফ স্তালিনের ছায়া দেখা যাচ্ছে। তারপরও তার কারবার দেখে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা হতবুদ্ধি হয়েই চলেছেন।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রুশ দুমা পুতিনের কাছে রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আবদার জানায়। রুশ রাষ্ট্রনায়ক প্রথমে বলেন, কথিত জমজ প্রজাতন্ত্রকে এখনই তিনি স্বীকৃতি দিতে নারাজ। নারাজির হেতু—স্বীকৃতি দেয়ার আগে তাকে সেই ভান ধরতে হবে, যাতে মনে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের তলায় জমা বিপুল গণচাপে, অর্থাৎ জনতার চাপে পিষ্ট ও অসহায় তিনি দুটি কচি প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীন বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এই ভানুমতির খেল রাষ্ট্রনায়ক পুতিন কোথা থেকে শিখলেন? ইতিহাস এবং স্মৃতি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা না করলে বলা যাবে, এই ভান পুতিনের মগজে ঢুকেছে স্তালিনের রঙ্গলীলা দেখে এবং বুঝে। ১৯২২ সালে স্তালিন প্রস্তাব করেছিলেন তার সরকার হলে, মতান্তরে তিনি সরকার হলে সোভিয়েত যুক্তরাজ্যের পাঁচটি প্রজাতন্ত্রের (ইউক্রেন, বেলারুশ, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া) আত্তীকরণ করবেন।
যদি হাল সিদ্ধান্তে আরসিপির কেন্দ্রীয় পরিষদ আমলে আনে, তাহলে এ প্রসঙ্গে প্রজাতন্ত্রগুলোর কেন্দ্রীয় পরিষদকে অবগত করা হবে, যাতে তারা সোভিয়েত মহা-সম্মেলনের আগে রুশ সোভিয়েতগুলোর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদগুলোতে অথবা কথিত প্রজাতন্ত্রগুলোর কংগ্রেসে বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। রাশিয়ার সোভিয়েত মহা-সম্মেলনে এই আত্তীকরণের সিদ্ধান্তকে প্রজাতন্ত্রগুলোর ইচ্ছা হিসাবে ঘোষণা করা হবে। অবশ্যই এই খবর জনগণের কাছে গোপন রাখতে হবে।
কেন্দ্রীয় পরিষদে স্তালিনের এমন প্রস্তাবের আসল প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, তা জানার উপায় রাখা হয় নাই। এই ঘটনা মূল-কাণ্ডসমেত কেবল গায়েবই হয় নাই, পুরো ঘটনাকে আগপাছ উল্টে মানুষের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। ঘটনাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন দেখে মনে হয়, কেন্দ্রীয় পরিষদের কথায় ঊর্ধ্বতন (সোভিয়েত) কর্তৃপক্ষ এমন আইন প্রণয়ন করেছে। যেন তা-ই হয়েছে যা কেন্দ্রীয় পরিষদ চেয়েছে, সোভিয়েত রাশিয়ার জনগণ চেয়েছে।
স্তালিনের এমন রঙ্গলীলার সবচাইতে প্রচলিত উদাহরণ ১৯৩৯। সে বছর তিন বাল্টিক রাজ্যকে (লিথুনিয়া, লাতভিয়া, এস্তোনিয়া) এমনভাবেই স্বেচ্ছায় সোভিয়েত যুক্তরাজ্যে যুক্ত হতে এবং সোভিয়েত যুক্তরাজ্যকে তাদের ইচ্ছার স্বীকৃতি দিতে দেখা গিয়েছিল।
১৯৩০-এর গোড়ায় স্তালিন যা করেছিলেন, তা ছিল সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লবপূর্ব জারতান্ত্রিক পররাষ্ট্র ও জাতীয় নীতির প্রত্যাবর্তন। উদাহরণ, সেকালে সাইবেরিয়া ও মুসলিম এশিয়ায় রুশ উপনিবেশায়নকে সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ হিসাবে আর না দেখে আধুনিকীকরণের প্রগতিশীল প্রস্তাবনা রূপে দেখার প্রচেষ্টা।
পুতিন গত সোমবার তার নিরাপত্তা পরিষদকে জড়ো করেন। প্রায় স্তালিনীয় কায়দায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের একে একে জিজ্ঞাসা করেন তারা স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্র দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বীকৃতির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে কি না। মতবিনিময়ের এক পর্যায়ে যখন বিদেশে রাশিয়ার টিকটিকিদের প্রধান সের্গেই নারিশকিনের পালা এল, ভদ্রলোক (পরামর্শ দিয়ে) রাষ্ট্রনায়কের সাজানো সুন্দর স্ক্রিপ্টে কালি ঢেলে দিলেন।
তার প্রথম পরামর্শ ছিল, পশ্চিমাদের একটা শেষ সুযোগ দেয়া যাতে তারা মিনস্ক চুক্তিতে ফিরে যেতে পারে। প্রয়োজনে একটা ছোটাখাটো আল্টিমেটামও দেয়া যেতে পারে। নারিশকিনকে এখানেই থামতে হয়েছে। আরো সোজা করে বললে, পুতিন তাকে আর এগোতে দেন নাই। বক্রচোখে স্থিরদৃষ্টে চেয়ে থেকে রাষ্ট্রনায়ক নারিশকিনকে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, 'এর মানে কী?', 'আপনি ঠিক কী পরামর্শ দিচ্ছেন? আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব? সমঝোতা না সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি?'
পুতিনের পাল্টা কথায় নারিশকিন থতমত খেয়ে যান। ঠিক কী বলবেন, কী বলতে হবে, কী বলা উচিত ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে বসেন। প্রথমে 'হ্যাঁ' তারপর বিড়বিড় করে 'না' বলতে বলতে তার মুখের মণ্ডল কয়েক সেকেন্ডের জন্য রক্তশূন্য হয়ে যায়, আর সেই অসুস্থ সেকেন্ড যেন কোনো দিন ফুরোবে না, এমন বোধ হতে থাকে। বিরতি ভাঙে পুতিনের তরফ থেকে, তিনি গম্ভীর স্বরে বলেন,'স্পষ্ট ভাষায় বলুন'।
চাপ আর বরদাস্ত করতে না পেরে, গোয়েন্দাপ্রধান উল্টোরথ ধরেন। আরো একমাত্রা বাড়িয়ে ঘোষণা করেন, আসলে বলতে চেয়েছিলেন—তিনি দোনেৎস্ক আর লুহানস্কের রুশ ফেডারেশনে সংযুক্তিকে সমর্থন করেন।
এরপরও নারিশকিনের মুক্তি মেলে না। তার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর কণ্ঠে পুতিন আবারও বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে কথা বলছি না। আমাদের কথা হচ্ছে তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি নিয়ে। আপনি বলেন আপনি তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে চান নাকি চান না। হ্যাঁ অথবা না।'
অতঃপর, বিহ্বল নারিশকিন যা বলেছিলেন, ফিরিয়ে নেন এবং ঘোষণা করেন: অবশ্যই, অবশ্যই তিনি এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। পুতিন বলেন, 'ধন্যবাদ, আপনি বসতে পারেন।'
নারিশকিনের প্রথম প্রস্তাবনা ছিলো কোমল (পশ্চিমাদের আরেকটি আল্টিমেটাম), তারপর আতঙ্কের কল্যাণে তার প্রস্তাবনা গিয়ে ঠেকল স্বাধীনতাকামী দুটি অঞ্চলের রুশীকরণে। এই ঘটনা একজন ভাষ্যকার যেভাবে দেখেন, 'ঘটনার নাটকীয়তা এতই তীব্র যে একে চলচ্চিত্র বা গল্প-উপন্যাসের দৃশ্য বলে ভুল হয়।'
এই দৃশ্যের সাাহায্যে একগাদা গোপন রিপোর্টের চাইতে অনেক সহজে রাশিয়ার ওপরমহলের পরিস্থিতি বোঝা যায়। সের্গেই নারিশকিন, রুশ গোয়েন্দা সংস্থার পররাষ্ট্র বিভাগের প্রধান, কেবল সংগ্রহে থাকা ডেটার কারণে যাকে নিয়ে তটস্থ হওয়া যায় সেই ব্যক্তি কিনা কথা বলতে গিয়ে তোতলান, ফ্যাকাশে হয়ে যান, আর তারপর তাকে এমনভাবে বসতে বলা হয় যেন সেই ইস্কুল ছাত্রকে বলা হচ্ছে, যে কিনা অনেক নেয়ে-ঘেমে শেষপর্যন্ত উত্তরটা ঠিকঠাক বলতে পেরেছে। এই হলো আজকের রাশিয়ায় 'জনগণের মন' বোঝার পদ্ধতি। গণ-মন বুঝতে মতবিনিময় চলে ওপরওয়ালার সঙ্গে অধস্তনের। প্রক্রিয়াটা এতো খোলামেলাভাবে দেখার এমন চমৎকার সুযোগ আমরা এক জীবনে আর খুব বেশি পাব বলে মনে হয় না।
জানুয়ারি ২০২২-এর কথা। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিও দুটি অঞ্চলকে স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পুতিনের কাছে আবেদন করে। পুতিন তখন দক্ষ আইনজ্ঞের ভান ধরেন, আবেদন খারিজ করে দেন। আমাদের মনে রাখা দরকার, ইউক্রেনে চলমান আগ্রাসন রাশিয়ার লেনিনপন্থী সিলসিলার কফিনে শেষ পেরেক। রাশিয়ায় লেনিনের পথ-পন্থার যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, এই আগ্রাসনের মাধ্যমে তাও প্রত্যাখ্যানের কাজটুকু সেরে ফেলা হয়েছে।
লেনিনের নাম শেষবার পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছিল ২০১৪ সালের ইউক্রেনীয় গণঅভ্যুত্থানের কল্যাণে। সেবার সেই ঘটনায় মসনদ হারাতে হয়েছিলো ইউক্রেনের রুশপন্থী রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকভিচকে। টেলিভিশনে আমরা দেখেছি, বিক্ষোভকারীরা কিয়েভে লেনিনের মূর্তি ভাঙছে। লেনিনের মূর্তির ওপর তাদের এতো ক্ষোভ, আক্রোশ, তীব্র আক্রমণের কারণ আমরা অনুধাবন করতে পারি। এতোদিন যাবত ইউক্রেনে লেনিনের ভাস্কর্যগুলো এক সোভিয়েত নিপীড়নের প্রতীক হিসেবেই ক্রিয়াশীল থেকেছে। আর সেই অরুশ নেশনকে রুশ আধিপত্যের অধীন বানানোর যে বিশেষ সোভিয়েত কায়দা, পুতিনের রাশিয়া তারই ধারাবাহিক সম্প্রসারণ।
এরপরও জাতীয় সার্বভৌমত্বের দাবিতে মাতাল ইউক্রেনের জনতার মূর্তিভাঙার উৎসবে বিদ্রুপের ইশারা কি টের পাওয়া যায় না! ইউক্রেনের জাতীয় পরিচয় জার-রাশিয়ায় গড়ে ওঠে নাই (তখন উল্টো ইউক্রেনীয় চেতনার ঘাড় মটকে দেয়া হয়)। সোভিয়েত যুক্তরাজ্যের প্রথম দশকে ইউক্রেন প্রথমবারের মতো তাদের জাতীয় পরিচয়কে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেয়েছিল। ১৯২০-এর গোড়ার দিকে ইউক্রেন শিল্প-সাহিত্যে একটি জাতীয় পুনরুত্থান পর্বের সাক্ষ্য বহন করে। সেই 'আবার' উত্থান সম্ভব হয়েছিল তাদের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের গুণেই। এমন কমিউনিস্ট নেতৃত্ব, যারা পুরোদমে 'ইউক্রেনীয়করণ'কে সমর্থন দিয়েছিল। তখন ইউক্রেনী ভাষার যাতে বিস্তার ঘটে সে বিষয়টি পর্যেবেক্ষণ করার বিশেষ দায়িত্ব ছিল লেনিনের ইউক্রেনীয় সহচর ও লেনিনপন্থী নেতা মিকোলা স্ক্রিপনিকের ওপর। এই 'স্বদেশীকরণে' অনুসরণ করা হয়েছিল লেনিনের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রণীত নীতিগুলো।
নিপীড়িত জাতিকে কোনো পীড়ক রাষ্ট্রের সীমায় গায়ের জোরে ধরে রাখার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই ছাড়া প্রলেতারিতের সামনে ভিন্ন কোনো পথ খোলা নাই। মনে রাখতে হবে, এটাই খোদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সংগ্রাম। যে নিপীড়ক নেশন 'তার মধ্যে থাকা' অপরাপর নেশনের কণ্ঠরোধ করতে চায়, তার বিরুদ্ধে প্রলেতারিতেকে অবশ্যই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। যারা উপনিবেশ তাদের অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে উপনিবেশক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার আছে, প্রলেতারিতেকে দাঁড়াতে হবে সেই অধিকারে পক্ষে।
এই অর্থে না ভাবলে, প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকের কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। নিপীড়ক ও নিপীড়িত নেশনের শ্রমিকের মধ্যে ভ্রাতৃপ্রেম, আস্থা, শ্রেণী-সংহতি দূরকল্পনাতেই থাকে।
লেনিন শেষদিন পর্যন্ত তার জবান ও অবস্থানে অটল ছিলেন। সোভিয়েত নীতিতে বদল আসে স্তালিন মসনদে বসার পর। কেন্দ্রীভূত ও একক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র গঠনের স্তালিনীয় প্রকল্পের বিরুদ্ধে লেনিন শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান। তিনি সোভিয়েত যুক্তরাজ্যের ছোট নেশনগুলোর রাজনৈতিক অর্থে আলাদা থাকার নিঃশর্ত অধিকারের পক্ষে (বিশেষ করে তৎকালীন জর্জিয়া) তার পুরোনো অবস্থানেই অবিচল থাকেন। বারবার সমর্থন দিয়ে যান সেইসব জাতিসত্তার পূর্ণ সার্বভৌমত্বকে যাদের নিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্র গঠিত হয়েছিল। আমাদের এ-ও স্মরণে রাখতে হবে, ১৯২২-এর ২৭ সেপ্টেম্বর পলিটব্যুরোর সদস্যদের লেখা চিঠিতে স্তালিন খোলাখুলি লেনিনকে 'জাতীয় উদারবাদী' বলে অভিযুক্ত করেছিলেন।
ফলে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি জারীয়-স্তালিনীয় লাইনেরই ধারাবাহিকতা। পুতিন মনে করেন, ১৯১৭-র বিপ্লবের পর, রাশিয়াকে জর্জরিত করার চমৎকার সুযোগ বলশেভিকরা লুফে নিয়েছিল:
নিজস্ব ভাবনা, নিজস্ব মত অনুসারে শাসন; ব্যপারটা খারাপ না, ততক্ষণ খারাপ না যতক্ষণ ঠিক কিছু ফলে—যেমনটা ফলেছিল ভ্লাদিমির ইলিচের সাথে। আমাদের দুর্ভাগ্য তার মত, তার ভাবনা সোভিয়েত যুক্তরাজ্য বিনাশের কারণ হয়েছিল। তার অনেক ভাবনাই সোভিয়েত যুক্তরাজ্যের সর্বনাশের জন্য দায়ী। একটা যেমন, সোভিয়েত অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ধারণা। আপনাদের অতীত জানতে হবে, কম্যুনিস্টরা কী করেছিল—একটা দালানের তলে তারা স্বরাজ নামে এক পারমানবিক বোমা স্থাপন করেছিল, দালানটা ছিলো আমাদের স্বপ্নের রাশিয়া—আমাদের রাশিয়া যা পরবর্তী বিকট বিস্ফোরণ হয়ে উবে যায়।
এককথায়, লেনিন রুশ সাম্রাজ্যের পয়দা করা শৃঙ্খলে বন্দি নেশনগুলোর স্বায়ত্তশাসনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা সরাসরি রুশ হেজিমনিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছিল। ফলে আজকের রাশিয়ার সাঁজোয়া কুচকাওয়াজে, জনতার গণ উল্লাসে আমরা যে স্তালিনের প্রতিকৃতিকে আবার ফিরে আসতে দেখছি, আমরা যে দেখছি লেনিনকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে—এভাবে এই ফিরে আসা আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া মোটেই আচম্বিত হওয়ার মতো ঘটনা নয়। কয়েক বছর পূর্বের এক জনজরিপে স্তালিনকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রুশদের মধ্যে তৃতীয় হতে দেখা গিয়েছিল, সেই জরিপে লেনিনের নাম কিন্তু কোথাও দেখা যায় নাই। আজকের রাশিয়াতে স্তালিনকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস, তার কারণ এটা নয় যে তিনি একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট ছিলেন। বরঞ্চ, লেনিনের দেশ অপ্রেম 'বিচ্যুতি'র পর সেই বিচ্যুতি থেকে স্তালিনই রুশ মহত্বকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন বলে আজকের রাশিয়া বিশ্বাস করে। পুতিন গত সপ্তাহে যখন দনবাস অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপের ঘোষণা দেন তখন কথাপ্রসঙ্গে তার পুরোনো দাবির পুনরাবৃত্তি ঘটান এমন ভাব ধরে—এই সেই লেনিন, যিনি রোমানভ রাজবংশের পতনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন, তিনিই ইউক্রেন কিতাবটির কর্তা, আধুনিক ইউক্রেনের স্রষ্টা: 'আসুন এইভাবে শুরু করা যাক যে, আধুনিক ইউক্রেন প্রধানত এবং পূর্ণত রাশিয়ার সৃষ্টি, আরো স্পষ্ট ভাষায় বললে—আধুনিক ইউক্রেন বলশেভিক, কমিউনিস্ট রাশিয়ার আওলাদ। এই প্রক্রিয়ার জন্ম হয় ১৯১৭-র বিপ্লবের পরপর।'
এরচাইতে আর ভালোভাবে, স্পষ্টভাবে রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক কি নিজের চিন্তাকে আমাদের সামনে হাজির করতে পারতেন? দুনিয়ার বামপন্থি যারা রাশিয়ার জন্য আজও নরম-হৃদয় হয়ে আছেন (যারা এখনো এই খোয়াব দেখতে ভালোবাসেন যে হালের রাশিয়া সোভিয়েত যুক্তরাজ্যের উত্তরাধিকার বহন করে, পুতিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পথের কাঁটা ইত্যাদি) তাদের একটা তিতা সত্য গিলতে পারতে হবে—তাদের বুঝতে হবে ভ্লাদিমির পুতিন একজন রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ছাড়া আর কিছুই নন।
রাশিয়া মোটেই তার কাটা-ছক বগলে নিয়ে শীতল যুদ্ধের চমৎকার সময়ে ফিরে যাচ্ছে না। তার চাইতেও আজব, তার চাইতেও উদ্ভট কিছু ঘটছে, যাকে ঠান্ডা যুদ্ধ না বলে দোজখের ওম (গরম শান্তি) বলাই ভালো। এটা এক স্থায়ী হাইব্রিড যুদ্ধের ওম, যেখানে সামরিক হস্তক্ষেপকে গণহত্যার বিরুদ্ধে শান্তিরক্ষী মানবিক মিশন বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর রাবার-স্ট্যাম্পমার্কা রুশ পার্লামেন্টে সদর্পে ঘোষণা করা হচ্ছে,'মানব বিপর্যয় ঠেকাতে গ্রহণ করা মহান উদ্যোগকে রাষ্ট্রীয় দুমার দ্ব্যর্থহীন পূর্ণ সমর্থন।'
প্রিয় বন্ধুরা, এই উদ্ভট রসালো নয়া বাস্তবে আপনাদের স্বাগতম।
- স্লাভয় জিজেক সমকালীন দুনিয়ার অন্যতম আলোচিত দার্শনিক ও সংস্কৃতি তাত্ত্বিক।
- জিজেকের মূল লেখাটি দ্য স্পেকটেটর ওয়ার্ল্ড এ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে সেটি অনুবাদ করেছেন: ইমরান কামাল, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়