মোদি কেন জিতে চলেছেন?
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে চমকপ্রদ ফল দেখিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের শক্তিশালী অবস্থানকেই দৃঢ় করেছে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে প্রতিপত্তির ওপর ভিত্তি করেই নয়াদিল্লিতে ক্ষমতা ধরে রেখেছে বিজেপি।
ভারতের জাতীয় রাজনীতির জয়-পরাজয় অনেকাংশেই উত্তর প্রদেশের ওপর নির্ভর করে, যা সামগ্রিকভাবে টেক্সাস, ফ্লোরিডা এবং ভার্জিনিয়ার সমতুল্য।
তবে উত্তর প্রদেশে দলটির জয়লাভের অর্থ এই নয় যে ইউপির ভোটাররা বিজেপির ওপর সন্তুষ্ট। গত দুবছর কঠিন সময় পার করেছে বিজেপি। গত বছরের মে ও জুনে করোনার ডেল্টা প্রকরণ ছড়িয়ে পড়লে উত্তর প্রদেশের স্বাস্থ্যখাত ভেঙে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতিসহ কর্মসংস্থান নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। বিরোধী দলসহ অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে ব্যাপক এই অসন্তোষ মোদির বেছে নেওয়া 'সন্ন্যাসী-রাজনীতিবিদ' মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে যাবে।
আদিত্যনাথের অধীনে রাজ্য সরকার তার কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রদর্শনে সরব ছিল। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেও রাজ্য সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে।
উত্তর প্রদেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা আদিত্যনাথের মেয়াদেও নিশ্চিতভাবেই অব্যাহত ছিল। সরকারি তথ্যের উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহরোত্রা দেখান যে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বছরে রাজ্যের উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগের সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদে প্রায় ৭ শতাংশ ছিল।
এমনকি পূর্ববর্তী সরকারের মেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী উৎপাদন খাত ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে আদিত্যনাথের সরকারের সময় এসে সংকুচিত হয়েছে। রাজ্যে বেকারত্ব এত বেশি যে সম্প্রতি চাকরির দাবিতে রাজ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও বিজেপি বেশ ভালো ব্যবধানে জিতেছে। এটা কি কেবল আদিত্যনাথের কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তির জন্য?
তবে এটা পুরো বিশ্লেষণের একটি দিক মাত্র। অনেক বিশ্লেষকের মতে, আজকের এই পপুলিজম বা জনতোষণবাদের যুগে কেবল অর্থনৈতিক বা শ্রেণিস্বার্থের কথা বলেই আইডেনটিটি পলিটিকসকে আটকানো সম্ভব। আইডেনটিটি পলিটিকসের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা গোষ্ঠীর পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সুতরাং শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের পুনরুদ্ধার ঘটলেই আপনি 'মিলিয়নেয়ার ও বিলিনেয়ার' বা মধ্যবিত্তের সংগ্রাম নিয়ে কথা বলবেন। অর্থনৈতিক শ্রেণিপার্থক্যকে জাতিগত পার্থক্যের চেয়েও বড় করে দেখেন এই বিশ্লেষকরা।
উত্তর প্রদেশে বিরোধীরাও সে পথে হেঁটেছে। তারা সরকারের ভুলক্রুটি, অর্থনীতির দুরাবস্থা এবং মহামারির বিপর্যয়ের জন্য বিজেপিকে দায়ী করে জোর প্রচারণা চালায়। তবুও তারা ভোট গণনার দিনে আবিষ্কার করে যে, ক্ষুব্ধ নাগরিকরাও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার জন্য পপুলিস্ট এই নেতাদের দায়ী মনে করছে না।
যারা মনে করেছেন যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা শুনেই মানুষের টনক নড়বে তারা সম্ভবত ভুলে গেছেন যে পপুলিস্টরা সব বিষয়েই ভোটাররা যেন 'অপর পক্ষ বনাম আমরা' এমন একটি দৃষ্টভঙ্গি রাখে, তা নিশ্চিত করেন।
উত্তর প্রদেশে লোকে ডেল্টা ওয়েভে মরেছে, চাকরির সংকটে ভুগেছে তাতে কী? হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বলতে পারে যে সরকারের অবহেলায় 'হিন্দু'দের অন্তত অন্য গোষ্ঠীর বেশি ভুগতে হয়নি। যদি অপর পক্ষ ক্ষমতায় থাকত, তখন কী ঘটত? তারা তো 'হিন্দুত্ববাদী স্বার্থে'র কথাও চিন্তাও করে না।
আশেপাশে যথেষ্ট চাকরি নাও থাকতে পারে। কিন্তু যদি সরকারি চাকরির সুযোগ মিলে, তাহলে অন্তত 'সঠিক' ধর্মের, 'সঠিক' বর্ণের ভারতীয়দের সারির পেছনে দাঁড়াতে হবে না। অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকদের মতে, বঞ্চনা পরম সত্য। একে এড়িয়ে চলা সম্ভব না। কিন্তু, পপুলিস্ট এবং তাদের ভোটারদের জন্য এগুলো আপেক্ষিক বিষয়।
ইউপিতে ভোটারদের অধিকাংশই সিদ্ধান্ত নেন যে আদিত্যনাথের হিন্দুত্ববাদী প্রতিনিধিত্ব ইঙ্গিত করে যে তিনিই হিন্দুদের স্বার্থ আদায়ে সরাসরি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। এমনকি ফলাফল যদি সন্তোষজনক না-ও হয়, তারপরও অন্য কোনো রাজনীতিবিদ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ইস্যুতে দায়িত্বশীল নন, তারা কোনোভাবেই এর চেয়ে ভালো কিছু করতে পারবেন না।
ইউপির ২০০ মিলিয়ন মানুষকে বশে আনা আদিত্যনাথের এই জয় অন্যান্য জায়গায় যারা ছোট-বড় পপুলিস্টদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন, তাদের জন্য শিক্ষামূলক। শুধু অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর মনোযোগ দেওয়া যথেষ্ট নয়। 'আইডেনটিটি পলিটিকস' ব্যবহার ও অপব্যবহারে দক্ষ নেতারা জোর দিয়ে বলবেন যে তারা একাই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। এমনকি যে সমস্যাগুলো তারা তৈরি করেছে সেগুলোও। কারণ বাকি সবাই দুর্নীতিবাজ বা শত্রুর জন্য কাজ করে।
এই পপুলিস্টরা কার্যকরভাবে অন্যদের ওপর দোষ চাপাতে পারেন। সংখ্যালঘু, বহিরাগত, বিদেশি কিংবা যে অভিজাত শ্রেণির কাছে পৌঁছানো যায় না, তাদের ওপরও তারা দোষ চাপিয়ে দিবেন। এই কাজ তারা সামনেও করবে এবং একইসঙ্গে ইতিবাচক ফলও পাবে। আর এসব ততক্ষণই চলতে থাকবে, যতক্ষণ তারা সামাজিক বিভাজনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। সমাজের এই বিভেদই তাদের শক্তিশালী করে।
লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গের কলামিস্ট। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।