২০৩০ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য
আগামী নয় বছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয়ে দশগুণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণেই এই পদক্ষেপ।
চামড়া ও চামজাড়াত পণ্য থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ ১০-১২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দশ বছর মেয়াদী রূপকল্প প্রণয়ন করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বর্তমানে এ খাতের রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলার।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি করা সম্ভব হলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে উন্নীত হবে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বিজনসে স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন করা সম্ভব। কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্ট করতে হবে। সরকারের নীতি সহায়তারও প্রয়োজন হবে।"
তিনি বলেন, "বিদেশি ক্রেতা আকৃষ্টে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ। তবে কারখানাগুলো পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট না হলে এই সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব নয়। আর বিদেশি ক্রেতা ও পণ্যের দাম বেশি পেতে এটা অবশ্যই প্রয়োজন।"
তিনি জানান, কমপ্লায়েন্স ঠিক না থাকায় বিদেশিরা এখন কম দামে চামড়া কিনছে। কমপ্লায়েন্ট হলে এই পণ্যের দাম হবে আর রপ্তানি আয়ও বাড়বে বলে জানান তিনি।
তবে বাংলাদেশের মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান এই সার্টিফিকেট পেয়েছে। বড় অংশই কমপ্লায়েন্ট না হওয়ায় সার্টিফিকেট পায়নি, যা এই খাতে রপ্তানি বৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায় বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস (ইসিফরজে) এর আওতায় 'চামড়া খাতের রপ্তানির রূপরেখা' খসড়া প্রণয়ন করা হচ্ছে। রূপকল্পটি হালনাগাদের কাজ করছে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।
দেশের প্রধান রপ্তানিখাতগুলোর মধ্যে শুধু চামড়া ও পাটপণ্যের শতভাগ কাঁচামালের যোগান আসে দেশ থেকে।
মন্ত্রণালয় ও চামড়াখাতের ব্যবসায়ীরা জানান, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৬ লাখ ও পরোক্ষভাবে আরও তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে চামড়া শিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ আর দেশের মোট জিডিপির ০.৫ শতাংশ।
বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে এখন শীর্ষ দেশ চীন।
বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানির বড় বাজার ইতালি, স্পেন, হংকং। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে নীতি সহায়তা পেলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এইক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ 'কমপ্লায়েন্স' নিশ্চিত করা। কারণ বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর মূল নিয়ামক হিসাবে কাজ করে চামড়াখাতের পণ্যগুলোর কমপ্লায়েন্স।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমছে। বর্তমানে এই রপ্তানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের কম।
মূলত কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে সাম্প্রতিক সময়ে চামড়া রপ্তানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যদিও সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩০ শতাংশ।
শাহিন আহমেদ বলেন, চামড়া রপ্তানি উর্ধ্বমুখীই ছিল কিন্তু জোরপূর্বক ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ থেকে সাভারে সরিয়ে নেওয়ার সময় থেকেই রপ্তানি কমছে। কমপ্লায়েন্স ও আরও কিছু ইস্যুতে এই রপ্তানি বাড়ানো যাচ্ছে না।
চামড়া শিল্পের প্রসার ও সম্প্রসারণে ২০১৭ সালকে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও চামড়াজাত পাদুকাকে বর্ষ পণ্য ঘোষণা করে সরকার।
অন্যদিকে ২০১৯ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করে শিল্প মন্ত্রণালয়, তাতে ২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা ও জিডিপিতে এই খাতের অবদান বাড়িয়ে ১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালের পর থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানির পরিমাণ ১১২.৪১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩.৪০ কোটি ডলার, যা এ যাবতকালে সর্বোচ্চ।
এরপর থেকে পরপর তিনবছর চামড়া ও চামড়াজাত্র পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ কমছে। করোনা মহামারির সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় ৭৯.৭৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ২১.৭৯ শতাংশ কম।
তবে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪.১৬ কোটি ডলার।
ইপিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি। দ্বিতীয় স্থানে সিমেন্ট, লবণ, পাথর, আকরিক এবং পেট্রোলিয়াম বাই-প্রোডাক্টের মতো শিল্পজাত দ্রব্য। তৃতীয় স্থানে পাট ও পাটজাত পণ্য। এরপরই চামড়া শিল্প।
২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতের মোট রপ্তানির ১২,২৭ ও ৬০ শতাংশ চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও চামড়াজাত পাদুকা থেকে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের চামড়া শিল্পখাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৬৮.৭৪ কোটি ডলার, যা যা আগের বছরের চেয়ে ২৯.৬৬ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এই রপ্তানি আয় ছিল ৫২.৬৬ কোটি ডলার।
চামড়া রপ্তানির বিশ্ববাজার
গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের নতুন একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্যের বিশ্ব বাজারের আকার ৬২৪.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এই সময়ের মধ্যে সিএজিআর হবে ৫.৯ শতাংশ।
বৈশ্বিক ব্যবসায়িক ডেটা প্লাটফর্ম স্ট্যাটিস্টা অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী রপ্তানিকৃত চামড়াজাত পণ্যের ৩০.৩ শতাংশি রপ্তানি করে চীন। এরফলে বিশ্বের শীর্ষ চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক হয়ে ওঠে দেশটি।
বিশ্বব্যাপী মোট রপ্তানির ১৭.৮ ও ১৪.৮ শতাংশ ইতালি ও ফ্রান্সের।
ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো এশিয়ান দেশগুলো রপ্তানি ছিল ৬.৪ ও ২.৬ শতাংশ।