ফিল্ম আর্কাইভের রত্নভাণ্ডার
হাতে লেখা চিত্রনাট্য
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সংগ্রহে আছে প্রায় ৩০০০ চিত্রনাট্য। তার মধ্যে হাতে লেখা চিত্রনাট্যের সংখ্যা অর্ধেকের কম হবে না। কিছু আছে টাইপ রাইটারে টাইপ করা আর অনেকগুলো কম্পিউটার টাইপের। সবগুলোই কালো রঙের হার্ডকভারে বাঁধাই করা। সাধারণত ফুল স্কেপ অংক বা বাংলা খাতায় কালির কলম বা বলপয়েন্ট দিয়ে লেখা হয়েছে হাতে লেখা চিত্রনাট্যগুলো। কোনো কোনোটি কার্বন পেপারেও লেখা হয়েছে। আর সেসবের আলোচনায় যাওয়ার আগেই চিত্রনাট্য বিষয়ে কিছু চিরন্তন আলাপ সেরে নেওয়া দরকার।
চিত্রনাট্যের ইতিহাস
লুমিয়ের ভাইরা ১৮৯৫ সালে যখন ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার বা বেবির ব্রেকফাস্টের দৃশ্যধারণ করেছেন তখন কি তাদের হাতে চিত্রনাট্য ছিল? উত্তর না হলেই বুঝি ভালো হয়। তখন তো ছবি তোলার কারিগরি ব্যাপারটাই কেবল চিন্তায় থাকার কথা।
১৯০২ সালে নির্মিত জর্জ মেলিয়েসের 'এ ট্রিপ টু দ্য মুন' একটি সাড়া জাগানো ছবি। তখনকার দীর্ঘতম ছবিটি ১৪ মিনিটের। ছবিটির চিত্রনাট্য বলতে দৃশ্যগুলোর টাইটেল যেমন- দ্য ওয়ার্কশপস, লোডিং দ্য গান, দ্য মনস্টার গান ইত্যাদি।
১৯০৩ সালে পোর্টারের 'দ্য গ্রেট রবারি'তে দেখা গেল দৃশ্যগুলো বর্ণনাকারে লেখা হয়েছে। যেমন ইন্টেরিয়র অব রেইলরোড টেলিগ্রাফ অফিস শিরোনামের পর লেখা মুখোশপরা ডাকাতরা ভিতরে ঢুকে সিগনাল ব্লক কব্জা করে। ১৯১১ সালে ইনস নামের এক নির্মাতা ওয়েস্টার্ন ছবি বানানোর উদ্দেশ্যে খুব পরিকল্পিতভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন।
তিনি কন্টিনিউটি স্ক্রিপ্ট চালু করেন- যাতে দৃশ্যটায় কে আছে, দৃশ্যের ঘটনাটা কী, এক্সটেরিয়র না ইনটেরিয়র- ইত্যাদি লেখা হয়েছিল। পরে তিনি গ্রিফিথের সঙ্গে মিলে ট্রায়াঙ্গল স্টুডিও গড়ে তোলেন ১৯১৫ সালে যেখানে সিনেমাটোগ্রাফার, অভিনয়শিল্পী, সম্পাদনাকারী, সাউন্ড রেকর্ডিস্টদের নাম নিবন্ধিত ছিল। এভাবে চলতে চলতে ১৯৪২ সালে নির্মিত 'ক্যাসাব্লাঙ্কা'য় আমরা একটি চিত্তাকর্ষক চিত্রনাট্যের দেখা পাই।
তারপর ১৯৫৫ সালের পর প্রয়োজন হয়ে পড়ে ডিটেইলড শুটিং স্ক্রিপ্টেরও, যাতে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলও লেখা হতে থাকে। এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট যেমন প্রোডিউসার, অভিনয়শিল্পী, ডিস্ট্রিবিউটর সকলেই অর্থ বা সময় বিনিয়োগের আগে ছবিটির ভবিষ্যত বুঝে নিতে পারছিল।
এমন একটি শুটিং স্ক্রিপ্টের পাঁচটি প্রধান বৈশিষ্ট্য থাকে, যেমন- সিন হেডিং (ইন্টেরিয়র, মধ্যবিত্তের ঘর), অ্যাকশন (বিথি টেবিলে বসে হোমওয়ার্ক করছে, হঠাৎ একটা তীব্র চিৎকার ভেসে এলো), শট ধরন (ওভার দ্য শোল্ডার), সংলাপ (বিথি ঘুমে বিভোর মাকে: মা, ও মা ওঠো তাড়াতাড়ি), ট্রানজিশন (বিথির দৃশ্যটি ফেড আউট হয়ে শেষ হবে এবং নতুন দৃশ্য ফেইড ইন হয়ে শুরু হওয়ার কথা বলা থাকবে)। এক কথায় বলা যায়, কার্যকর একটি স্ক্রিনপ্লে বা চিত্রনাট্যের চল শুরু হয় গত শতকের চল্লিশের দশকে।
প্রথাগত চিত্রনাট্য যেমন হয়
শুরুর দৃশ্যে ছবির সারাংশ প্রকাশ করা হয়। তারপরের কিছু দৃশ্যে প্রধান প্রধান চরিত্র, সময়কাল, ছবির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়। তারপর দেখানো হয় সমস্যাগুলো। তারপর এমন কোনো ঘটনা ঘটে যাতে প্রধান পাত্র-পাত্রীর জীবন বদলে যায়। তারপর সমস্যাগুলোকে এমনভাবে ঘনীভূত করা হয়, যা এড়াতে পারে না নায়ক বা নায়িকা। তারপর একটা চমক তৈরি করা হয়, যা গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারপর আবার সমস্যাগুলোকে উজ্জীবিত করা হয়- যেন দর্শক নড়েচড়ে বসে। এবার নায়ককে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় পৌছাতেই হয়।
সিদ্ধান্ত ভুল হলে ব্যর্থতা আর সিদ্ধান্ত ঠিক হলে সাফল্য। গৃহীত সিদ্ধান্তের ওপর পরিকল্পনা নিতে দেখা যায় নায়ক বা নায়িকাকে, এক পর্যায়ে হানতে হয় চরম আঘাত। ফলাফলে মধুর সমাপ্তি অথবা বেদনায়ক দৃশ্যের অবতারণা। গলেপর শেষে এবার হয় নায়ক বিপর্যস্ত হয় অথবা ভিলেন পালানোর পথ খোঁজে। সবশেষে একটা বার্তা দিয়ে থাকেন পরিচালক, যেমন সত্যেরই হয় জয় বা মৃত্যুতেই হয় না সব শেষ-ইত্যাদি (পুরো ব্যাপারটি 'থ্রি-অ্যাক্ট প্লে' নামে সারা বিশ্বেই চালু আছে। হলিউডি-বলিউডি সুপারহিট প্রায় সব সিনেমা এ ফর্মুলায় তৈরি। তাই এগুলো ফর্মুলা ফিল্ম নামেও পরিচিত)।
উল্লেখ্য, একটি পেশাদার চিত্রনাট্যের প্রতি পাতায় প্রচুর খালি জায়গা রাখা হয় যেন পরিচালক পরে প্রয়োজনীয় সংকেত লিখে রাখতে বা দৃশ্যকল্প এঁকে রাখতে পারেন।
চিত্রনাট্য বিষয়ে সত্যজিৎ রায়
চিত্রনাট্য হল ছবির কাঠামো। ইমেজ ও ধ্বনির দ্বারা পর্দায় যা ব্যক্ত হবে, এ হল তার লিখিত ইঙ্গিত। এই কাঠামোকে অবলম্বন করেই চলচ্চিত্রের কলাকুশলীগণ পরিচালকের নির্দেশে সমবেতভাবে চলচ্চিত্রকে সাবয়ব, সজীব করে তোলে। চিত্রনাট্য তাই অবহেলার জিনিস নয়। এতে যদি খুঁত থাকে- তাহলে ছবির অঙ্গসৌষ্ঠবে তার প্রতিফলন হতে বাধ্য, তা সে পরিচালনা যতই সুষ্ঠু হোক। (সূত্র: চলচ্চিত্র, বার্ষিকী; ১৯৫৯)
আবার আনন্দবাজার পত্রিকা, শারদীয়, ১৯৬৩ তে লিখছেন: চিত্রনাট্য রচনার সবচেয়ে বড় কথা বোধহয় এই যে, চিত্রনাট্যকার তার নিজস্ব সত্তাকে সম্পূর্ণ বিলীন করে, তার চরিত্রের অন্তরে প্রবেশ করে সেই চরিত্রের সত্তাটিকে সংলাপের দ্বারা ফুটিয়ে তুলবেন। আরেকটি জরুরি কথা মনে রাখা দরকার যে, চলচ্চিত্রে সময়ের দাম বড় বেশি। যত অল্প কথায় যত বেশি বলা যায়, ততই ভাল; আর কথার পরিবর্তে যদি ইঙ্গিত ব্যবহার করা যায়, তবে তো কথাই নেই।
যদি কোন চিত্রনাট্যকার সাহিত্যের সংলাপ থেকে তালিম নেবার প্রয়োজন বোধ করেন, তবে আমি একজন সাহিত্যিকের নাম নির্দ্বিধায় করতে পারি। তিনি হলেন স্বর্গত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্রনাট্যের সংলাপ রচনার এত বড় গুরু, আর কেউ নেই। বিভূতিভূষণের সংলাপ পড়লে মনে হয়, যেন সরাসরি লোকের মুখ থেকে কথা তুলে এনে কাগজে বসিয়ে দিয়েছেন। …অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও স্মরণশক্তি না থাকলে এ ধরনের সংলাপ সম্ভবপর নয়। বলা বাহুল্য, চিত্রনাট্য রচয়িতার পক্ষেও এ দুটি গুন অপরিহার্য।
উল্লেখ্য বিশ্বসেরা ১০ চিত্রনাট্য লেখিয়েদের অন্যতম সত্যজিৎ রায়।
আরো যারা সেরা
দ্য ওয়েস্ট উইং, আ ফিউ গুড ম্যান, মানিবল- ইত্যাদি বিশ্বখ্যাত ছবির চিত্রনাট্যকার অ্যারন সরকিন। অভিনেতা হতে চেয়ে আশির দশকে ফুটফরমাশ খাটার কাজও করেছেন সরকিন। একটা শিশু থিয়েটার দলের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন অ্যালাবামায়। লেখক হওয়ার কথা ভাবেনওনি কখনো, জানতেনও না তাঁর এই প্রতিভা আছে।
একদিন যখন বাসায় বসে বসে অপেক্ষা করছিলেন এক বন্ধুর জন্য, কী ভেবে একটা আইবিএম ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে কয়েক পাতা লিখে ফেলেন। পরে এক সাংবাদিক বন্ধু সেগুলো পড়ার পর বললেন, ভিতরে ভিতরে সংলাপ ঢোকাও। তাতে সেটা একসময় হয়ে উঠল চিত্রনাট্য। আর তারপর থেকেই রচিত হতে থাকল ইতিহাস। সংলাপ ও আত্মকথন তৈরিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
ট্যারান্টিনোর 'টুয়েলভ ইয়ারস আ স্লেভ' দেখা আছে অনেকেরই। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন জন রিডলে। নিউইয়র্কের একজন স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান ছিলেন রিডলে। সেসঙ্গে কোনো কোনো টিভির জন্যও গল্প দিতেন। একসময় তিনি একটি উপন্যাসও লিখে ফেলেন, সেটির নাম 'স্ট্রে ডগস' আর তা পাঠক টানতে ভীষণভাবে ব্যর্থ হলো আর তারই ফলশ্রুতিতে হলিউডে তাঁর জন্য দরজা খুলে গেল। অলিভার স্টোন ওই উপন্যাসটিকেই চিত্রনাট্যে রুপ দিতে চাইলেন। ঘণ্টা ঘণ্টা তারা একসঙ্গে কাজ করলেন। ১৯৯৭ সালে তৈরি হলো সুপারহিট ছবি ইউটার্ন। তারপর থেকে রিডলে আর সময় পাননি জিরানোর। টুয়েলভ ইয়ারস আ স্লেভ, আমেরিকান ক্রাইম, গেরিলার মতো ছবির চিত্রনাট্যের রচয়িতা তিনি।
পরিচালক কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনোও একজন ভালো চিত্রনাট্যকার। সংলাপ দিয়ে একাধিক চরিত্রের মেলবন্ধন ঘটানোয় দারুণ পারদর্শী। আবার অল্প কথায় উত্তেজনা তৈরিতেও মাস্টার। বিশেষ করে, তাঁর 'পাল্প ফিকশন' ছবির অনেক কথাই মানুষের মনে গেঁথে গেছে আর থাকবেও অনেকদিন।
সেরাদের মধ্যে আছেন গদারও। ফরাসী নিউ ওয়েভ ধারার চলচ্চিত্রকার জা লুক গদার তৈরি করেছেন 'ব্রেথলেস'। তিনি প্রভাব রেখেছেন মার্টিন স্করসেজে, কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো বা সিভেন সডেরবার্গের মতো নির্মাতার ওপর।
বলতে হয় উডি এলেনের কথাও। অ্যানি হল, ম্যানহাটান বা মিডনাইট ইন প্যারিসের মতো অসাধারণ সব গল্পের রচয়িতা উডি। রসাত্মক যা একইসঙ্গে বিদ্রুপাত্মকও; তেমন তেমন সংলাপ তৈরিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তবে বিশেষজ্ঞরা আরো গুরুত্ব দেন, তার বিষয় নির্বাচনের ওপর- যেগুলো একইসঙ্গে স্থানীক এবং বৈশ্বিক যেমন একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি।
এই তালিকায় কোয়েন ব্রাদার্সকে না আনলে হয়ই না। বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ বিচারে তাদের ধারেকাছে কেউ নেই। মানোত্তীর্ণ কোনো উপন্যাসের চিত্রনাট্য তৈরি যে কঠিন কাজ, মানবেন নিশ্চয়ই। 'নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান' দিয়ে কোয়েন ব্রাদার্স মানে ইথান কোয়েন ও জোয়েল কোয়েন ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন। এছাড়াও তাদের মুকুটে আছে হেইল সিজার, মিলারস ক্রসিং, হু ওয়াজন্ট দেয়ার ইত্যাদি ছবির পালক।
এছাড়াও সেরাদের তালিকায় উঠবে ইংমার বার্গম্যান, আন্দ্রেই তারকাভস্কি, অলিভার স্টোন, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, স্ট্যানলি কুব্রিক, চার্লি কফম্যান, বিলি ওয়াইল্ডার প্রমুখের নাম।
চিত্রনাট্য নিয়ে উক্তি
'একটি ভালো ছবি বানাতে তিনটি জিনিস দরকার- ভালো চিত্রনাট্য, ভালো চিত্রনাট্য এবং ভালো চিত্রনাট্য' – আলফ্রেড হিচকক
'ভালো চিত্রনাট্য মাস্টারপিস তৈরি করতে পারে' – আকিরা কুরোসাওয়া
'চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্যের চেয়ে জরুরি কিছু আর নেই' – রিচার্ড অ্যাটেনবরো
'চিত্রনাট্য হচ্ছে স্বপ্ন, আর চলচ্চিত্র হচ্ছে ওই স্বপ্নের বাস্তবায়ন' – জর্জ লুকাস
'ভালো ছবি আপনি আশাই করতে পারেন না, যখন ভাবনা অগোছালো থাকে' – জা লুক গদার
'সবাক যুগে চিত্রনাট্যই চলচ্চিত্রের ভিত্তি, অথচ তা বুঝতে অনেকেরই দেরি হয়ে গেছে' – বিলি ওয়াইল্ডার
'চলচ্চিত্র হলো আশি ভাগ চিত্রনাট্য, বাকী ২০ ভাগ হলো অভিনয়, ব্যস শেষ' – উইলিয়াম ওয়াইলার
'ভালো চিত্রনাট্য থেকে খারাপ ছবি বানানো সম্ভব, কিন্তু ভালো চিত্রনাট্য ছাড়া ভালো ছবি বানানো অসম্ভব' – জর্জ ক্লনি
'চিত্রনাট্য ভালো করে গোছান, দেখবেন সব ঠিকমতো চলছে' – স্টিভেন সডেরবার্গ
'চিত্রনাট্যে ফাঁক থাকলে, চলচ্চিত্রে গর্ত তৈরি হয়' – রিডলি স্কট
চিত্রনাট্য আসলে যেমন
'কাপড় আয়রন করার মতো ব্যাপার হলো চিত্রনাট্য। অল্প এগিয়ে আবার পেছাতে হয়, তারপর আবার এগুতে হয় এবং শেষে দারুণ কিছু ঘটে' – পল থমাস অ্যান্ডারসন
'আত্মা, মন আর অভিজ্ঞতা সব যদি একসঙ্গে জুড়তে পারা যায়, তবে একটা ভালো লেখা হয়' – ভার্জিনিয়া উলফ
'কল্পনাকে আমরা একটা নিয়মের মধ্যে আনি প্রথমে, তারপর তার মধ্যে আশা যোগান দিই আর তা দিতেই থাকি' – ওয়াল্ট ডিজনি
'ভাবতে থাকুন আপনার কল্পনার চরিত্রগুলো কেমন করে হাসে, খেলে বা বলে। ভালো করে খেয়াল করুন, চিত্রনাট্য দাড়িয়ে যাবে' – দিপেশ নেপাল
'চিত্রনাট্য আমার কাছে সমীকরণের অংকের মতো যা সমাধান করতে হয়' – আজগার ফরহাদি
'চিত্রনাট্য লেখার সময় আমি দর্শকদের কথা ভাবি না বরং পাঠকের কথাই ভাবি' – কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো
'চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে পাহাড়ে চড়ার মতো ব্যাপার। আপনি যখন চড়ছেন, তখন কেবল সামনে পাথর দেখবেন। কোথা থেকে আসছেন আর কোথায় যাচ্ছেন- তা কিন্তু দেখা যায় না' – সিডনি অ্যালভিন ফিল্ড (মার্কিন লেখক)
'চিত্রনাট্য নিজে কোনো শিল্প নয় বরং আমন্ত্রণপত্র। একটি শিল্প তৈরির আমন্ত্রণপত্র' – পল শ্রাডের।
ভিন্নপথের যাত্রী
গঠনের দিক থেকে চিত্রনাট্য হয় দুই প্রকার-মৌলিক ও সাহিত্যাশ্রিত চিত্রনাট্য। বাংলা মৌলিক চিত্রনাট্যে অপর্না সেনের নাম শুরুতেই আসে। পরমা, ৩৬ চৌরঙ্গী লেন, সতী, পারমিতার একদিন- এর মতো দারুণ সব মৌলিক চিত্রনাট্য উপহার দিয়েছেন তিনি। দারুণভাবে সমাজ ও সময় সচেতন তার ছবিগুলো।
সাহিত্যাশ্রয়ী ছবির অন্যতম আরেক রুপকার মৃনাল সেন। তবে মূল লেখার প্রতি সত্যজিতের মতো আনুগত্য প্রদর্শনে তিনি রাজি ছিলেন না। বলেছেন, আনুগত্য রেখেই নিজের মতো কাজ করার অধিকার আমার আছে। রমাপদ চৌধুরীর 'বীজ' উপন্যাস অবলম্বনে একদিন 'আচানক' নামে একটি ছবি তিনি করেছেন। সেই ছবির প্রধান চরিত্র বই পাগল রিটায়ার্ড প্রফেসর। ছবিটির একটি কথা এমন- 'মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হচ্ছে- মানুষ জীবনে একবারই শুধু বাঁচে'। মৃনাল বলেছেন, এই কথাটাই আমাকে টেনেছে বেশি আর এ কথাটা মাথায় রেখেই ছবিটি আমি বানিয়েছি।
মৃনাল সেন চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে তিনটি বিষয়ের প্রতি আনুগত্যের দায় অনুভব করেন- লেখকের মূলক ভাবনার প্রতি, চলচ্চিত্র নামক শিল্প মাধ্যমের প্রতি এবং বর্তমান সময়ের প্রতি।
সাধারণভাবে চিত্রনাট্য হলো আখ্যান। তবে মৃনাল বর্ণনাধর্মী আখ্যান পরিত্যাগ করে খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে জোড়া দেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও (বাঘবাহাদুর, চরাচর, লাল দরজার পরিচালক) তেমনটা করেন।
আর জা লুক গদারকে বলা হয় বর্ণনাবিরুদ্ধ চলচ্চিত্রকার। ইরানী চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামীর অনেক ছবিও বর্ণনাবিরুদ্ধ। তারপর বাংলা চলচ্চিত্রের বিদ্রোহী পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের কথায় আসা যাক। তাঁর শেষ ছবি 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো'র বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশ। ছবিটিতে তিনি গল্প রেখেছেন যুক্তি আর তর্ককে দাঁড় করাতে যেখানে সাধারণত গল্প সাজাতে যুক্তি আর তর্ক হাজির করা নিয়ম। এ ছবিতে তার প্রধান চরিত্র একজন মাতাল। আর একে ঘিরেই জড়ো হতে থাকে চোর, বাটপার, দালাল বা নকশালবাদী। এদের প্রত্যেকেরই অতীত আছে, আর সকলেই বিভ্রান্ত।
ফিল্ম আর্কাইভের রত্নভাণ্ডার
'নান্টু ঘটক' ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮২ সালে। গাজী মাজহারুল আনোয়ার ছবিটির পরিচালক। আর্কাইভের তালিকার এটি ৯০১ নম্বর চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্যের প্রথম পৃষ্ঠার একেবারে ওপরে 'বিসমিল্লাহ' লেখা। তারপর লেখা বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে গুলাইল মেরে জিনিসপত্র ভাঙছে ও সই করছে। তারপর টাইটেল। পরে সিকোয়েন্স টু, ইনডোর/এক্সটেরিয়র লিখে বলা হচ্ছে- একটা ঘণ্টা থেকে ক্লোজ শট। ঘণ্টা বাজছে, ওয়াইড হয়ে স্কুল দেখা যাবে। ছাত্ররা ঢুকছে।
সিকোয়েন্স থ্রিও ক্লোজ শট দিয়ে শুরু। স্কুল রুমে চশমা মোছা দেখানোর কথা লেখা। রোল কল করতে গিয়ে শিক্ষক খেয়াল করলেন নান্টু অনুপস্থিত। আরেক ছাত্র জানাল, সে গুলাইল প্র্যাকটিস করছে।
পঞ্চম সিকোয়েন্সে ফালতু ঘটকের (নান্টুর বাবা) বাড়ি। দিনের বেলা। ইন্টেরিয়রের পরে লেখা কলের গান বাজছে-
'জন্ম মৃত্যু আর বিয়া
এই তিনটি সত্য দিয়া..'
সিকোয়েন্স সাতে গিয়ে লেখাগুলো আবছা হয়ে গেল। বুঝলাম বলপয়েন্টের কালি ফুরিয়েছে। নতুন বলপয়েন্টে ১৭ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে পরিচালকের নোট ইংরেজিতে লেখা- ক্যামেরা প্যান লেফট টু রাইট, রাজ্জাক গেটস আপ, অ্যাপ্রোচ টু হিজ ফ্রন্ট।
৪৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা, নান্টুর কন্টিনিউটি বুঝিয়ে দিতে হবে। এরপর নীল কালিতে নতুন কিছু সংলাপ (শুটিংয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে সম্ভবত)।
চিত্রনাট্যটি লেখা হয়েছে, একপাতা পর পর। সব সময় বাঁয়ের পাতা খালি রাখা হয়েছে। একান্ন নম্বর পাতার আগের পাতায় লেখা সুচরিতা: ৩৪+৩৪/এ+৩৪বি, আলমগীর: ৩৪+৩৪বি (সম্ভবত কন্টিনিউটির কথা বলা হয়েছে)
৫৮ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা, অঞ্জনার হাতে স্যান্ডেল থাকবে? ৭৮ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা, আলমগীরের একটা এন্ট্রি শট নিতে হবে।
শেষ বাণী: বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর (ফ্রিজ)। মোট নব্বই পৃষ্ঠার চিত্রনাট্য।
জীবন থেকে নেয়ার চিত্রনাট্যটি আর্কাইভ তালিকার ৮৩৯ নম্বর। জহির রায়হান পরিচালিত ছবিটির চিত্রনাট্যও তাঁর। সংলাপ আমজাদ হোসেনের। সিকোয়েন্স ওয়ান হলো আনোয়ারের বাড়ি। মিড ক্লোজ শটে রাতের বেলায় পোস্টারে তুলি দিয়ে লেখা হচ্ছে- রক্তাক্ত ২১ ফেব্রুয়ারি ভুলব না। মোট ২২৭ পৃষ্ঠার চিত্রনাট্য।
শেষ কথা: হিটলারও ভুল করেছিল, তুমিও ভুল করেছো, সত্য কখনো চাপা থাকে না, সত্যের জয় হবেই হবে।
২১১ নম্বর চিত্রনাট্যটি রংবাজ ছবির। বলা হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশনের সূচনা করেন রাজ্জাক এই ছবিটি দিয়ে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটির পরিচালক জহিরুল হক। নীল বলপয়েন্ট কালিতে খুব গুছিয়ে লেখা চিত্রনাট্য। বর্ণনা বাম দিকে, আর সংলাপ ডান দিকে। সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত শিরীন-জাহেদের ঘরের ডিটেইলিং শুরুর পাতাতেই – মোড়া, দেয়ালঘড়ি, আলমারি, চুড়ি-পাউডার, পর্দা, রুমাল ইত্যাদি। এই ছবির চরিত্রগুলোর নাম এমন – রাজু, কালু, চিনি, মিন্টু, বাদল, জরীনা। বড়লোকদের নাম এমন – মাসুদ, সোহেল, ডলি। শিরীনরা থাকে বনগ্রাম। আর বড়লোকরা গাড়ি চালায় গুলিস্তানে।
সূর্য দীঘল বাড়ির চিত্রনাট্যটির নম্বর ২১৫। খুব গোছানো আর দারুণ পাঠযোগ্য চিত্রনাট্য এটি। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলগুলো পরিস্কার লেখা হচ্ছে এভাবে-স্লাইট টপ অ্যাঙ্গেল, প্যান জুম ইন, টিল্ট ডাউন, ডায়াগোনাল ইত্যাদি। এ ছবির লোকেশনগুলি এমন- রেশন দোকান, রেললাইন, তালগাইচ্ছা বাড়ি, ধানক্ষেত, ঢেঁকিঘর, বাঁশঝাড়, জাহাজঘাটা। জিনিসপত্র- হুক্কা, শানকী, বাঁশের চুঙ্গি, বাবুইয়ের বাসা, শাক, পাটখড়ি, এক আনা, কুপি, বাতাসা, কদমা ইত্যাদি। চরিত্রগুলোর নাম- জয়গুন, শফির মা, জোবেদ ফকির, হাসু, মায়মন, লালুর মা, লেদু, গদু পরধান, খলিল প্রমুখ। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী যৌথভাবে ছবিটি পরিচালনা করেন। দেশভাগের সময়কার এ কাহিনীর রচয়িতা আবু ইসহাক।
১০৩৮ নম্বর চিত্রনাট্যটি 'নাচে নাগিন' ছবির। ছবিটির লোকেশন বর্ণিত আছে, পাহাড়ি এলাকা, জঙ্গল, নাগমহল বা নদীর ঘাট। ছবিটির সমস্যার কেন্দ্র নাগমণি। এখানে বীনবাঁশি , সাপ আর বেজির উপস্থিতি অনেক। চরিত্রের নাম পদ্মা, ঝিনুক, নাগরানী, সর্দার বা চাঁদনী। খুব দ্রুত লেখা, শট ডিভিশন নেই। মোটমাট ১৭৮ পৃষ্ঠা।
আলোচনা শেষ হচ্ছে ৩২২০ নম্বর চিত্রনাট্যটি দিয়ে। ছবির নাম 'ভালোবাসা জিন্দাবাদ'। এর পরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস। মুক্তি পেয়েছিল ২০১৩ সালে। ছবির প্রায় শুরু মানে ৩নং দৃশ্যেই পাওয়া যায় ক্যাডার দল ও লিটনকে। ছেলেটি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, মাইক্রোবাস এসে তার পথরোধ করে। পরে শুরু হয় ধস্তাধস্তি। পরের দৃশ্যে ছেলেটিকে হাজির করা হয় সুলতান মীর্জার দরবারে।
তারপর পাওয়া যায় ভার্সিটি ক্যাম্পাস। সেখানে রবিন, পাপ্পু, হৃদয়, মেঘা, পদ্মলোচন, শাহীন, উত্তম আর শাহজাদার দেখা মেলে। এর মধ্যে পদ্মলোচন কথা বলে বরিশাইল্যা ভাষায়। ছবিতে প্রিন্সিপাল চরিত্রটিও হাস্যরসাত্মক। ইংরেজি কথাও আছে এতে যেমন 'সামথিং ওয়াজ রং'। ছবির বিশেষ শব্দাবলি- লদগা-লদগি, উথলে উথলে- ইত্যাদি।
বিশেষ সংলাপ (মীর্জার মুখে): কলেজে পড়ার সময় দুই-চাইরটা প্রেম, দুই-চাইরটা সাপ্লিমেন্ট গাইডের মতো দরকার হয়।
মারাত্মক সংলাপ (সৌরভের মুখে): তোমার বাবাকে চ্যালেঞ্জ করছি- তোমাকে নিয়ে যাব বর সেজে।
ছবি শেষ হয় হো হো হাসি দিয়ে। শেষ কথা- বিয়েতে দেরি কেন, চিকেন খাওয়া যাবে, চিকেন জিন্দাবাদ, ভালোবাসা জিন্দাবাদ।
উল্লেখ্য বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ চিত্রনাট্যগুলোর ডিজিটাল তালিকা তৈরি শুরু করেছে। আর্কাইভের লাইব্রেরিয়ান আসমা আক্তার বললেন, আমাদের প্রথম কিউরেটর একেএম আব্দুর রউফের সময় থেকেই চিত্রনাট্য সংগ্রহ শুরু হয়েছিল। আমাদের ফিল্ম অফিসার ফখরুল ইসলামেরও এ সংগ্রহে বড় ভূমিকা রয়েছে।