বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, মজুরি না বাড়ায় শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী
বেলচা, টুকরিসহ রাজমিস্ত্রির কাজ করার উপকরণ নিয়ে নিজের শ্রম বিক্রি করতে রোববার সকাল ১০টায় রাজধানীর পান্থপথ মোড়ে বসেছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব মমতাজ হোসেন। তার সাথে কথা বলতে চাইলে শুরুতে ব্যাপক উৎসাহ দেখালেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে উৎসাহে ভাটা পড়ে।
পাশেই বসে থাকা আজিজুল জানান, সকাল সাতটা থেকে বসে থাকলেও কোনো কাজ পাওয়া যায়নি। কয়েকজন দরদাম করলেও বনিবনা না হওয়ায় আজকের দিনটি হয়ত কর্মহীন কাটাতে হবে।
এ সময় মমতাজ জানান, কয়েক বছর আগেও এক দিন কাজ করে ছয়শ থেকে সাতশ টাকা পাওয়া যেত। এখন দক্ষ শ্রমিকরদের ৫০০ টাকাও দিতে চায় না অনেকেই। ২০ দিনের মতো কাজ করতে পারলে মজুরি বাবদ পাওয়া যায় হাজার দশেক টাকা। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য সেবার মূল্য পরিশোধে পাঁচ সদস্যের পরিবারের বাজার খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পরে।
এ সময় শ্রমিকরা জানান চাল, ডাল তেল, লবণসহ নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে কোনোভাবেই সংসারের ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যেই নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ভবন নির্মাণের কাজও কমে এসেছে। এর ফলে দৈনিক হাজিরার মজুরি কমেছে। আবার অনেক দিন কাজও পাওয়া যায় না।
মমতাজ আর আজিজুলের কথার প্রতিফলন অনেকটাই উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভোক্তা মূল্যসূচক ও শ্রমসূচক জরিপেও। গতকাল প্রকাশ হওয়া প্রতিবেদনে বিবিএস বলেছে, ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ভোক্তা মূ্ল্য সূচক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.১৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতির এ হার গত ১৭ মাসে সর্বনিম্ন ছিল। অন্যদিকে একই সময়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষের মজুরি হার বেড়েছে মাত্র ৬.০৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চাইতে নিচে নেমে আসা অর্থনীতির জন্য অশনী সংকেত। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি না বাড়লে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় তথা ক্রয় ক্ষমতা কমে আসে। বাড়তি ব্যয় মেটাতে তারা খাদ্য, শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা বিভাগে শ্রমকিদের মজুরি হার ৪.৯২ শতাংশে নেমে এসেছে। জাতীয় মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি হার ১.২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে কম বেড়েছে। এ হিসাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ে রাজধানীর শ্রমিক শ্রেণির লোকজনই সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সিরিজ ডেটা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজধানীর মজুরি হার গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে।
গত ডিসেম্বর মাসেও ঢাকায় মজুরি হার ছিল ৫ শতাংশের বেশি। গত ডিসেম্বরে এর হার ছিল ৬ শতাংশের ওপর। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঢাকায় মজুরি বেড়েছিল ৮ শতাংশ। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মজুরি বেড়েছিল ৫.১২ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের চাইতে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেশি হারে বেড়েছে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা এখনও তাদের আগের অবস্থায় ফিরতে পারেননি। এর ফলে পরিবারের নিত্যপণ্যের ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য এখন অনেক শ্রমিকেরই নেই। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি কম মূল্যে খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করা ও শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নগদ হস্তান্তর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "পণ্যমূল্য বৃদ্ধির তুলনায় শ্রমিকদের মজুরি কম বাড়ায় তারা আগের সমান পণ্য কিনতে পারছেন না। এর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা হলো শ্রমিক শ্রেণির প্রকৃত আয় কমেছে।"
তিনি বলেন, "বছর বছর মাথাপিছু আয়ে দুই সংখ্যার প্রবৃদ্ধির মধ্যেও শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া হতাশার। এর অর্থ হলো জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সুফল শ্রমিক শ্রেণি পাচ্ছে না। পুঁজিপতি ও রেন্টসিকারদের কাছেই কুক্ষিগত হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সুফল।
তিনি আরও বলেন, "আয় কমলে শ্রমিক শ্রেণি প্রথমেই খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন। সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়িয়ে এনে কোনো একটা কাজে দিয়ে হলেও অনেকেই টিকে থাকার চেষ্টা করেন। অনেকেই চিকিৎসা ব্যয় কমাতে বাধ্য হন। এতে দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন ব্যাহত হয়, ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতাও কমে আসে।"
এ অবস্থায় দরিদ্র মানুষদের মাঝে দ্রুত রেয়াতি সুবিধায় খাদ্যপণ্য সরবরাহ জোরদার করার পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ বাড়ানোরও সুপারিশ করেন তিনি।
গত বছরের আগস্টে গেজেট জারি করে নির্মাণ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি শহরে ১,০২০ টাকা ও গ্রামে ৯,৪০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে শ্রমিকরা এর অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব)-এর সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক।
তিনি জানান, সর্বনিম্ন গ্রেডের শ্রমিকদের ৬৮০ টাকা মজুরি পাওয়ার কথা থাকলেও সরকারি ভবন নির্মাণের কাজেও ৪০০ টাকা হাজিরায় কাজ করানো হয়।
তিনি বলেন, চাল, ডাল, তেল ও অন্যান্য দ্রব্যের দাম বাড়লেও মজুরি কমছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পরিবার নিয়ে টিকে থাকা শ্রমিকদের জন্য সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনি শ্রমিকদের জন্যে রেশনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত মাসে নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের মজুরিসূচক বেড়েছে মাত্র ৪.৪৪ শতাংশ, যা এর আগের মাসে ছিল ৪.৩১ শতাংশ। টানা কয়েক বছর ধরেই এ খাতে মজুরি হার মূল্যস্ফীতির অনেক নিচে।
২০১৮ সালে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির নির্দেশনা ওই গেজেটে থাকলেও তা মানা হচ্ছে না বলে দাবি করেন শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশু্র।
তিনি বলেন, হাতেগোণা কয়েকটি কারখানায় নিয়মিত বেতন বাড়লেও অনেক কারখানায় তা করা হয় না। কিছু কারখানায় তিন বছরে এক বার বেতন বেড়েছে। আবার কিছু কারখানায় একবারও বাড়েনি।
অবশ্য অধিকাংশ পোশাক কারখানায় নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি করা হয় বলে দাবি করেন নিট পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ'র নেতা মোহাম্মদ হাতেম।